Tuesday 10 April 2018

विद्यापति / বিদ্যাপতির পদাবলী

বিদ্যাপতির পদাবলী:

জয়দেব বাঙালি হয়েও ভারতের অবাঙালি সমাজে যেমন অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, বিদ্যাপতি অবাঙালি হয়ে তেমনই বাঙালি সমাজে অসামান্য সমাদর লাভ করেছেন। তিনি মিথিলার অর্থাৎ উত্তর বিহারে অধিবাসী অথচ বাংলাদেশেই বাঙালিরা প্রথমমেই তাঁর পদ সংগ্রহ করে তাঁর কবি কর্মের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে গিয়েছেন। বিদ্যাপতি বাঙালি সমাজে কত বড় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তার পরিমাণ নির্ণয় করতে গেলে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু থেকে শুরু করে আধুনিক কালের রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই বিদ্যাপতি সঙ্গে নিজেদের অন্তরের একটা নিগূঢ় যোগসূত্র কল্পনা করে তাঁর পদাবলীর মাধুর্যকে আস্বাদন করেছেন। বাঙালি তাকে 'মৈথিল কোকিল', 'কবিকুলচন্দ','রসিক সুভাভূষণ সুখকন্দ','রসধাম','কবিপতি','কবি-সার্বভৌম' ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করে কৃতার্থ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে নিজেকে উদার কাব্যরসিক হিসেবে সপ্রমাণিত করেছে।

বিদ্যাপতির আর্বিভাব কাল:

বিদ্যাপতির আর্বিভাব কাল নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সে সম্পর্কে সঠিক ভাবে কিছু জানা যায়নি। বিদ্যাপতির পূর্বপুরুষগণ মিথিলার রাজবংশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেজন্য মিথিলার রাজবংশের ইতিহাস থেকে বিদ্যাপতির কালনির্ণায়ক কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সন-তারিখের নানা বৈষম্য ও ক্রুটি বিদ্যমান থাকার কারণে নিঃসংশয় ভাবে গ্রহন করা যায় না। এছাড়াও বিদ্যাপতির মৈথিলী পদাবলী ও অবহট্ট ভাষায় রচিত গ্রন্থের মধ্যে তৎকালীন ঐতিহাসিক ঘটনার কিছু কিছু উল্লেখ দেখা যায়। তবে পদাবলী থেকে বিদ্যাপতির আর্বিভাব কাল সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যেতে পারে। এছাড়াও বিদ্যাপতির সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে নানা রাজবংশের উল্লেখ আছে, কোথায় ও বা তিনি সন-তারিখের ব্যবহার করেছেন। এগুলি কবির আর্বিভাব কাল নির্ণয়ে একটু সাহায্য করে।

বিদ্যাপতির একটি পদের ভূমিকাতে রায় নসরত-এর নামোল্লেখ দেখা যায়;-"কবিশেখর ভণ অপরূব রূপ দেখি।/রাএ নসরদ সাহ ভজলি কমলমুখি"।।

রায় নসরত ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দ জৌনপুর অধিকার করেন এবং১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। কাজেই অনুমান করা যেতে পারে বিদ্যাপতি চতুর্দশ শতকের শেষভাগে বর্তমান ছিলেন।

বিদ্যাপতির জীবনকথা:

বিদ্যাপতির জীবনকথা সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু জানা যায় না। তবে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, গিয়ার্সন প্রমুখ পণ্ডিতগণ কর্তৃক আহৃত তথ্যপঞ্জি থেকে কবি বিদ্যাপতির ব্যক্তিজীবনের কিছুটা তথ্য পাওয়া যায়। বিদ্যাপতি দ্বারভঙ্গা জেলার অন্তর্গত বিসফী গ্রামের এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম গণপতি। তাদের কৌলিক উপাধি হলো ঠাকুর। পুরুষানুক্রমে তাঁরা মিথিলার রাজবংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কবির পূর্বপুরুষগণ সকলেই মিথিলার রাজসভায় উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।তাঁর পিতামহ জয় দত্তের আমল থেকে বিদ্যাশিক্ষার দিকে তাদের বংশের মোর ফেরে। বিদ্যাপতির পিতা গণপতির সময় অবশ্য বংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। তথাপি ঠাকুর বংশের ঐতিহ্য গুনে বিদ্যাপতি মিথিলার রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

বিদ্যাপতি মৈথিলী ভাষায় যে পদাবলী রচনা করেন এবং অবহট্ট ভাষায়'কীর্তিলতা'নামে যে গদ্য-পদ্যময় চম্পুকাব্য প্রণয়ন করেন, তা থেকে তাঁর জীবনকথা সম্পর্কে কিছু পরিচয় লাভ করা যায়। কীর্তিলতা তে বিদ্যাপতি'ওইনীবার' ব্রাহ্মণ বংশের কীর্তিকথা উল্লেখ করেন। ঐ বংশের রাজা গগনেশ্বর ১৩৭২ খ্রিস্টাব্দে অসলান নামক এক মুসলমানের কাছে পরাভূত হয়ে নিহত হন। তখন তাঁর দুই পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ দেশত্যাগ করে জৌনপুরে চলে যান এবং সেখানকার শাসনকর্তা ইব্রাহিম শাহের সহায়তায় তাঁরা অসলান কে পরাজিত করেন। কীর্তিসিংহ এরপর রাজা হন। এই রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি'কীর্তিলতা' কাব্য প্রণয়ন করেন। কীর্তিসিংহ এর মৃত্যুর পর তাঁর পিতৃব্য দেবসিংহ সিংহাসন লাভ করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি 'ভূপরিক্রমা' গ্রন্থ রচনা করেন।দেবসিংহের পর তাঁর পুত্র শিবসিংহ অল্পকালের জন্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। তারই উৎসাহে বিদ্যাপতি অবহট্ট ভাষায়'কীর্তিপতাকা' ও সংস্কৃতে 'পুরুষপরীক্ষা' রচনা করেন। শিবসিংহের পর তাঁর ভ্রাতা পদ্মসিংহ রাজা হন। তাঁর পত্নী বিশ্বাস দেবীই রাজ্য পরিচালনা করতেন। কবি বিশ্বাস দেবীর নির্দেশেই'শৈবসর্বস্বসার' এবং'গঙ্গাবাক্যাবলী' রচনা করেন। এরপর বিদ্যাপতি ওই বংশের নরসিংহের নির্দেশে'বিভাগসার','লিখনাবলী' এবং ভৈরব সিংহের নির্দেশে'দুর্গাভক্তি' তরঙ্গিনী রচনা করেন। এসকল তথ্যপঞ্জি থেকে বোঝা যায় বিদ্যাপতি আজীবনকাল মিথিলা রাজবংশের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এসেছেন। রাজবংশের সাহচর্যে এসে বিদ্যাপতি যে প্রভূত ধনমান অর্জন করেছিলেন তাঁর পরিচয় পাওয়া যায় শিবসিংহের তাম্রপাত্রে উৎকীর্ণ দান-পত্রে। এই কারণেই বিদ্যাপতিকে'অভিনব জয়দেব' নামে অভিহিত করা হয়েছে।

Friday 6 April 2018

Krishna Character Of Srikrishnakirtan/ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণচরিত্রের অভিনবত্ব


 শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণচরিত্রের অভিনবত্ব:

দীর্ঘকাল ধরে পদাবলী সাহিত্য পাঠের সূত্রে কৃষ্ণচরিত্রের যে মহিমান্বিত, প্রেমিক অথচ সম্ভ্রম উদ্রেককারী ব্যক্তি হিসাবে কৃষ্ণ চরিত্রের যে দৈব মহিমা বাঙালি পাঠক পরিচিত হয়েছে, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্রের সঙ্গে তা কোন সাদৃশ্য নেই। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে জন্ম খন্ডে কৃষ্ণের আর্বিভাবের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যে কারণ দেখানো হয়েছে সেখানে কিন্তু পৌরাণিক মহিমার অবকাশ ছিল। কবি আমাদের জানিয়েছেন;-"কংসের কারণে হ এ সৃষ্টির বিনাশে"। কংস নিধনের কারণে বিষ্ণুর স্বয়ং কৃষ্ণ রূপে মর্তে আর্বিভাব এবং দেবী লক্ষ্মী রাধা রূপে মর্তে আগমন হয়েছে। কিন্তু এই পর্যন্তই তাম্বুল খন্ড থেকে রাধাবিরহ অংশ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনীর যে বিস্তার সেখানে কিন্তু এই সম্ভ্রমযুক্ত পৌরাণিক দৈব মহিমার কোনো অবকাশ নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে যে কৃষ্ণকে আমরা পেয়েছি তিনি মথুরা-বৃন্দাবনের আদিম পল্লীর এক রুচিহীন অবাঞ্চিত গো-তরুণ। অর্থাৎ বলা যেতে পারে জন্ম খন্ড এবং যমুনা খণ্ডে কিছু পুরাণ কথা ছাড়া এ কৃষ্ণের কোথাও দেবত্বের এতটুকুও অবকাশ দেখা যায় না।

তাম্বুল খণ্ডে আমরা শ্রীকৃষ্ণকে পাই, রাধা সম্ভোগের প্রতি তাঁর অধিক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। বড়াই বনমধ্যে রাধাকে হারিয়ে কৃষ্ণের কাছে শরনাপন্ন হলে কৃষ্ণ চতুরতার দ্বারা বড়ায়িকে রাধার রূপের বর্ণনা করতে বলেন;-"উদ্দেশ বুলিব মঁবে রাধিকার আহ্মে।/তঁবে ভালমঁতে তার রূপ কহ তোহ্মে"।। রাধার রূপের কথা শুনে কৃষ্ণ রাধার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বড়ায়ির মাধ্যমে কর্পূর মিশ্রিত তাম্বুলসহ প্রেম প্রস্তাব প্রেরণ করেন। কিন্তু রাধা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এবং আমাদের জানিয়ে দেয় সে পরপুরুষের স্ত্রী। ভদ্রতার অবকাশ থাকলে, রুচি স্নিগ্ধ মনের অধিকারী হলে কৃষ্ণ এরপরে অপ্রসন্ন হতেন না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ছলা-কলার আশ্রয় নিয়েছে।

তারই ফলশ্রুতিতে দানখণ্ডে রাধার পথ অবরোধ করে কানু প্রথমে তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশষণ করেন অতি নির্লজ্জভাবে এবং তার কাছে বারো-বছরের দান চেয়ে বসেছে। রাধা যৌবন অধিকারের জন্য আত্মম্ভরিতা ও আত্মস্ফালন তিনি কম করেননি;-"তোর কংসে মোর কিছু করিতেঁ না পারে।/তোহ্মারি সে রূপেঁ মোরে মরিবারে পারে"।।

কৃষ্ণের এরকম আত্ম অহমিকা প্রকাশক উক্তি দানখন্ডে প্রচুর আছে। রাধার সমস্ত অনুরোধ, অনুনয় উপেক্ষা করে অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণ তাকে বলপূর্বক সম্ভোগের আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ করেছে।

নৌকাখণ্ডে দেখি একইভাবে কৃষ্ণ ঘাটিয়াল এর বেশ ধারণ করে যমুনার ঘাটে রাধার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাধার সমস্ত সখীদের পরপার করবার পর একা রাধাকে নৌকায় তুলে মিলনের প্রস্তাব দিলেন কৃষ্ণ। নৌকাডুবি করিয়ে রাধার প্রাথমিকভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কৃষ্ণ জল-বিহারে মেতে উঠেছে।

ভারখন্ডে অবশ্য রাধার চাতুুরির কাছে কৃষ্ণকে হার মানতে হয়েছে। সেই সঙ্গে নিজের মর্যাদাহানির বেদনা ও লজ্জা যুক্ত হয়েছে। এই খণ্ডে মিলনের আশা দিয়ে ও রাধা তা রক্ষা করতে পারেন পারিনি।

ফলে ছত্রখণ্ডে দেখি'কোপিল কাহ্নাঞি'রাধার সঙ্গ ছাড়ছেন না। কিন্তু রাধা ও সহজে ছাড়ার পাত্রী নন। শেষ পর্যন্ত রাধা রতিদানের সম্মত হন কিন্তু একটি শর্তে। বড়ায়ি কৃষ্ণকে সেই শর্তের কথা জানায়;-"তোর ভাগেঁ দিল রাধা রতি অনুমতী।/হরিষ করিআঁ তার মাথে ধর ছাতী"।।

পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ বৃন্দাবন খন্ডে আমরা দেখি কৃষ্ণের আকুলতা রাধাকে পাবার যে কৌশল ও অভিষ্ট সিদ্ধতে সক্ষম হয়েছে। রাধাকে দেওয়া পরামর্শ অনুসারে কৃষ্ণ অনান্য গো-বধূদের ঘর থেকে বার করে এনেছে তা তৈরি উদ্যানে।

♦কিন্তু বৃন্দাবন খন্ডের এই ঘটনার পর ও এই গ্রামীন প্রেমিকের স্থূল আচরণ আমাদের বারবার আহত করে। হারখণ্ডে এই কৃষ্ণই রাধার হার চুরি করেও রাধার অভিযোগকেও অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, রাধার চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ ও অক্লেশে উচ্চারণ করেছে যশোদার কাছে।

পরবর্তী বাণখণ্ডে তারই প্রতিক্রিয়ায় আর বড়ায়ির প্ররোচনায় কৃষ্ণ-রাধার প্রতি নিষ্ঠুর বাণ নিক্ষেপ করেছেন। কিন্তু এরপর ব্যাকুল আর্ত কৃষ্ণ-রাধার জন্য ক্রন্দন করেছে। এক সময় কৃষ্ণের মুখে উচ্চারিত হয়েছে;-"আহ্মার জীবন রহে তোহ্মার জীবনে"।। এই একটি কথাই যেন এক পলকে সমস্ত রূঢ়তা আর স্থুলতার আবরণ সরিয়ে কৃষ্ণের প্রেমিক সত্তাকে উন্মোচিত করে।

আবার বংশীখণ্ডে কৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়ে রাধাকে উন্মাদিনী করে তুলেছে।

রাধাবিরহ অংশে দেখি কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে আবার মিলিত হয়েছে। মিলিত হওয়া সত্বেও প্রেমের আবহ তেমন সৃষ্টি হয়নি। রাধা সম্পর্কে তিনি অশালীন শব্দের প্রয়োগ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে চলে গেছে।সূচনায় রাধা যাই থাকুক না কেন, এখন তিনি শুধুমাত্র  কৃষ্ণ সমর্পিত প্রাণা। এখন তার মন ও শরীর শুধুমাত্র কৃষ্ণের জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে। অথচ চতুর নাটোরের মত কৃষ্ণ তার ইচ্ছা পূরণ  করেও রাধার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক রাখেনি। 

সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পুরুষের ক্ষেত্রে এই সামাজিক অন্যায় আমরা প্রত্যক্ষ করি। কৃষ্ণের আচরণের মধ্য দিয়েই তারই পুনরাবৃত্তি সেখানে আর যাই থাক, তথাকথিত দেবত্বের চিহ্নমাত্র নেই। একান্তভাবেই বিশেষ করে লৌকিক সংস্কৃতি অবলম্বন করে কৃষ্ণকে সৃষ্টি করলেন বড়ু চন্ডীদাস। পরবর্তীকালে রচিত পদাবলী সাহিত্যে কৃষ্ণ অপ্রাকৃত ভাব-বৃন্দাবনের চিরকিশোর প্রেমিক। জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'এর নায়কের মতোই মূর্তিয়মান'উজ্জ্বলনীলমণি'। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃষ্ণ তাঁর অজস্র উৎকট অসঙ্গতি নিয়েও শিল্পীর হাতে আঁকা জীবন্ত মানুষ।

Wednesday 4 April 2018

There Are Many Differences Between Srikrishnakirtan & Vaishnava Recitals/শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে নানান মিল-অমিল


"শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে নানান মিল-অমিল সত্বেও'রাধা বিরহ' অংশের দিকে লক্ষ্য রেখে রসিক সমালোচক কে অনুসরণ করে আমরা ও ও বলতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধার যেখানে শেষ, পদাবলী রাধার সেখানে আরম্ভ"।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য বৈষ্ণব পদাবলী উভয় ক্ষেত্রেই রাধা কৃষ্ণের প্রেম মূলক বিষয়বস্তু রূপে চির অদৃত। তবে বৈষ্ণব পদাবলী যেমন প্রাকচৈতন্য, চৈতন্য সমসাময়িক ও চৈতন্য উত্তর এই তিন পর্যায়ে বিন্যস্ত এবং প্রতিটি যুগের ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা তার মধ্যে লক্ষণীয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য কিন্তু তেমনটা নয়, কারণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য একজন কবির রচিত নির্দিষ্ট একটি আখ্যানকাব্য। আর বৈষ্ণব পদাবলী কয়েক শতাব্দী ব্যাপী অনেক অনেক কবি বা পদকর্তার রচিত বহু পদের সমষ্টি, তাই তা পদাবলী।

দেশ-কাল-সময় প্রেক্ষিতে এই দুই ধরনের রচনা স্বতন্ত্রতা লক্ষণীয়। বড়ু চণ্ডীদাস যেশ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য রচনা করেছেন তা চৈতন্য পূর্ববর্তী কালের রচনা। পক্ষান্তরে পদাবলী সাহিত্য প্রাকচৈতন্য চৈতন্য উত্তর যুগের ভিন্ন ভিন্ন কবিদের সৃষ্টি। এই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী চৈতন্য যুগের ব্যাপারটি কোন কাকতালীয় যোগমাত্র নয়, প্রাক্ চৈতন্য পর্বের কোন গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় দর্শনের প্রভাব শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মধ্যে ছিল না। কিন্তু পদাবলী সাহিত্য তা চৈতন্য পরবর্তী পর্বেতে বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য হিসাবে পরিগণিত হয় করা হয়।

মধ্যযুগের সব সাহিত্যই ছিল গেয়। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী উভয়ই গীত হত। উভয়েরই আবেদন ছিল রসিকজনের শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাছে। রাগ তাল ও লয়ের উল্লেখ উভয় ক্ষেত্রে লক্ষ্য করার মতো।

তবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য গ্রন্থে প্রতিটি চরিত্র ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে; যা বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে কখনোই তা সম্ভব হয়নি। বড়ু চন্ডীদাস ও বিষ্ণু পদকর্তারা রাধার বিরহিনী মূর্তি অংকনে অধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন- এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে বড়ু চন্ডীদাস তাঁর স্বাতন্ত্রতার পরিচয় পায়। তাঁর রাধা ধূলিমলিন ধরিত্রীর রক্তমাংসে গড়া মানবী। এ রাধার অঙ্গে অঙ্গে সুপরিচিত মাটির ঘ্রাণ। এ রাধা প্রথম থেকেই কৃষ্ণের প্রস্তাবে প্রতিবাদী, কৃষ্ণ তাঁকে বলপূর্বক অধিকার করেছেন। তাই বহু চন্ডীদাসের রাধা প্রথমে শ্যামবীত রাগিনী ও পরে তিব্র ও চুরান্ত রূপে অনুরাগিনী তে পরিণত হয়েছেন। এই অনুরাগিনী রাধার মধ্যে বিরহবেদনা সঞ্চারিত হয়ে পদাবলী রাধার সঙ্গে এক সমতলে স্থাপিত হয়েছেন তিনি। মিলন উল্লাসের অবসানে রাধার হৃদ-বৃন্দাবনে বেজেছে বিরহের বাঁশি। পদাবলী রাধার মতো বড়ুর রাধাও বংশীধ্বনি শ্রবণে ব্যাকুল হয়ে বলেছেন;-" আকুল শরীর মোর বে আকুল মন।/ বাঁশির শবঁদে মো আউলাইলোঁ রান্ধন"।। অর্থাৎ বংশী খণ্ড থেকেই এই রাধা কৃষ্ণের প্রতি পূর্ব বর্তায় অনুরক্ত হয়েছে। এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল ভারখন্ড থেকেই। বংশী খণ্ড ও রাধাবিরহ অংশে তা অপূর্ব ইতিবাচক পরিণতি। তা সত্ত্বেও এই রাধা শেষপর্যন্ত মানবী। মোটকথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা লৌকিক নায়িকা। তারমধ্যে ভাব-বৃন্দাবনের যোগিনীপারা রাধার স্তিমিত আভাস হয়তো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভাবনবলতার প্রৌঢ় 'পারাবতী' হতে সে পারিনি। তাই আমরা বলতে পারি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা'পূর্ব রাধা' ও বৈষ্ণব পদাবলির রাধা'উত্তর রাধা'। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী উভয়ই রাধা কৃষ্ণলীলায় সমুজ্জ্বল।

অন্যদিকে কৃষ্ণচরিত্রের মধ্যেও গভীর স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়। পদাবলীর কৃষ্ণ আভীর পল্লীর কোন এক অমার্জিত, অশালীন যুবক নয়; এ কৃষ্ণ গরিমাময় এবং ভক্তের আবেদনের প্রতি সম্ভ্রমশীল চরিত্র। শুধু রাধা তার কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলেন না, দৃঢ় আক্লেশে, অনায়াসে পরম আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসেন রাধার কাছে;" দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরই দেবতা"। এই গরিমা, এই ভাব-সন্ধ্যার ভাব মাধুর্য্যময় মধুর রসের এই ঘন সংবদ্ধ রূপ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রে তা অপ্রতিফলিত ঘটেছে দেখা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃষ্ণ চতুর নাটোরের মত। ছলে-বলে-কৌশলে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে প্রথম থেকেই রাধাকে অধিকার করার জন্য উন্মুখ। কবি বড়ু চন্ডিদাস কৃষ্ণ চরিত্র পরিকল্পনা ও তার চিত্রায়নে কবি মৌলিকতা ও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় বজায় রেখেছেন পদাবলী সাহিত্য থেকে।

পদাবলী সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষাও ভাবের কোন কোন জায়গায মিল যে় ধরা পড়ে না, তা কিন্তু নয়। কৃষ্ণের বাঁশি রাধা কে উন্মনা করে তুলেছে, বাঁশির ধ্বনিতে রাধা যে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিল তা দু জায়গাতেই রয়েছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভঙ্গি বা Approach বস্তুটাই আলাদা। তার মূল কথা হল প্রেম নয়, দুঃখের মধ্যদিয়েই ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া নয়, তা শুধুই ছলে-বলে-কৌশলে আকাঙ্ক্ষিত নারীর শরীর দহন করা। পদাবলী সাহিত্যে যে মাধুর্যের মূর্ছনায় ধূলুণ্ঠিত হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তা আমরা কল্পনা করতে পারিনা।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একইসঙ্গে গীতিধর্মী ও নাট্যধর্মী; আর বৈষ্ণব পদাবলী তত্ত্বের আধারে হলেও মূলত গীতিধর্মী। পদাবলীর জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপক, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তা থাকার কথা নয়। সাধারণ কতকগুলি ঘটনা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নাট্যধর্মিতার প্রাধান্য বড়ু চন্ডীদাসের কাব্যে দেখা যায়।শেষ পর্যন্ত বলা যেতে পারে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের প্রেম কথার অন্তরালে যে ভাবভাবনা বহমান তা গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী। অপরদিকে, পরচৈতন্য বৈষ্ণব পদাবলী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনানুসারী। পদাবলীতে রাধার মধ্যে আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইছা নয়,  কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছায়  মূখ্য। অর্থাৎ আমরা পুনরাবৃত্তি করে বলতে পারি সবচেয়ে বড় কথা বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য তা একেবারেই নয় যদিও সেখানে রাধা ও কৃষ্ণের কথাই পরিবেশিত হয়েছে।

Popular