Thursday 29 March 2018

Radha Character of Srikrishna Krittan / রাধা চরিত্র

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা এবং পদাবলী সাহিত্যের রাধা কি এক? রাধা চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা কর।

পদাবলী সাহিত্যে যে রাধা চরিত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেই অর্থে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা তার থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। পদাবলীর রাধা ভাব-বৃন্দাবনের অধিবাসিনী। প্রথম থেকেই সেই জন্যই যোগিনী সেজে কৃষ্ণের উপাসনা শুরু করেছেন। তাঁর মধ্যে প্রেমের প্রথম বিস্ময় চাঞ্চল্য নেই। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা প্রকৃতপক্ষে মানবী। একই সঙ্গে একথা বলবার যোগ্য, পদাবলী সাহিত্যে রাধার যে উপান্তর ভাগে ব্যঞ্জনা সর্বাংশে বিদ্যমান, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে মানবিকতা থেকে সদ্ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সূচনা তাম্বুল খণ্ডে। এই খণ্ড কাব্যের ভাগবত উপক্রমণিকা বটে। রাধাকৃষ্ণের আচরণ প্রকৃত নরনারীর পর্যায়ে নেমে এলো। রাধা সব সখিজনদের সঙ্গে মিলে বড়াই কে নিয়ে চলেছেন বৃন্দাবন থেকে মথুরার পথে। যেতে যেতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বড়াই তখন রাধাকে খুঁজতে খুঁজতে কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন। কৃষ্ণ রাধাকে আগে কখনোও দেখেনি। বড়াই তাই কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপ বর্ণনা করে। এবং রাধার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। বড়াই এর হাত দিয়ে তাম্বুল, ফুল ইত্যাদি উপহার স্বরূপ রাধার কাছে পাঠান। কৃষ্ণের এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে রাধা এবং বড়াই কে সরষে বলেন;-" নান্দের ঘরের গরু রাখোআল তা সমে কি মোর নেহা"

দান খণ্ডে দেখি কৃষ্ণ বড়াই এর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মথুরার পথে দানী সেজে বসেছে, বড়াই সখী পরিবৃতা রাধাকে ভুলিয়ে সেখানে উপস্থিত করল। কৃষ্ণ রাধা দধি দুগ্ধ সবই নষ্ট করে বলপূর্বক রাধাকে সম্ভোগ করলেন। এবং ছলে বলে কৌশলে রাধার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার অভীষ্ট পূরণ করে। ক্ষোভে অপমানে রাধা কৃষ্ণকে অপমান বা ভৎসনা করে  বলেন;-"এক ঠাই বাঢ়িলাহোঁ নান্দের ঘরে।/চন্ডাল কাহ্নাঞি এবে বল করে।।"

নৌকা খণ্ডে দেখি কৃষ্ণ আবার পারের কান্ডারি সেজে যমুনার ঘাটে রাধার সঙ্গে নৌকাডুবি চলে জলকেলি করছে। এখানে রাধার মধ্যে প্রতিকূল বাম্যভাব দূর হলো। এখানে দেখবার তাম্বুল, ফুল দান এবং নৌকা খণ্ডে রাধার মধ্যে যে প্রতিরোধশীল, সেই প্রতিরোধের তীব্রতা  প্রায় হ্রাস পেয়েছে।

ভার খন্ড এবং ছত্র খণ্ড এ দেখি রাধা কৃষ্ণকে একই রকম প্রস্তাব দিয়েছেন, যে- কৃষ্ণ যদি তার ও পষণার ভার বহন করে তাহলে তিনি কৃষ্ণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। কিন্তু পুথি এখানে খন্ডিত। ছত্র খণ্ডে একইভাবে কৃষ্ণ রৌদ্রের তীব তাপ থেকে রাধাকে রক্ষা করার জন্য ছত্র ধারণ করেছে, এক্ষেত্রে রাধা তাকে রতি দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এরপর কাহিনীর মানবিক আবেদন অগ্রসর হয়ে চলল। বৃন্দাবন খন্ডে দেখি কৃষ্ণ এক অনুপম উদ্যান তৈরি করেছে। সেই উদ্যানে কৃষ্ণ রাধাকে আহ্বান জানিয়েছে। লক্ষণীয় স্বামীর গৃহ থেকে রাধাকে কিভাবে বার করে নিয়ে আসতে হবে তার কৌশল কথা রাধা বলে দিয়েছ। এই খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসলো। এবং তাদের পরিপূর্ণ মিলন ও ঘটলো।

যমুনা খণ্ডে এসেছে পৌরাণিক প্রসঙ্গ। এই খন্ডের মধ্যে কৃষ্ণের কালিয়া দমন, গোপী গণের সঙ্গী জলবিহার, নারীদের বস্ত্রহরণ ইত্যাদি বিবৃত হয়েছে। রাধা অন্য গোপীগণদের  সঙ্গী কৃষ্ণের মেলামেশাকে অপছন্দ করে, এই ঈর্ষাই প্রেমের বড় প্রমাণ।

হার খণ্ডের মধ্যে কৃষ্ণ রাধার হার অপহরণ করলে তিনি কৃষ্ণের কু-চরিত্রের কথা মা যশোদা কে বলে দিলেন;-" বাঁরে বাঁরে কাহ্ন সে কাম করে।/ যে 

'কামে হ এ কুলের খাঁখাঁরে"।। কৃষ্ণ এতে রাধার  প্রতি রুষ্ট হয়ে রাধাকে মদন বান হানলেন বাণ খণ্ডে। এই বাণ খন্ডের মধ্যে রাধার চরিত্রের বেশ পরিবর্তন লক্ষিত হলো। এখানে রাধার দেহাশক্তি বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

বংশী খণ্ডে রাধা উত্তীর্ণ যৌবনা নারীতে পরিণত হয়েছে। কৃষ্ণের বংশী ধ্বনি  শুনে রাধার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বড়াইয়ের উপদেশে রাধা কৃষ্ণের বাসি চুরি করে নিলেন। কিন্তু পরে সে অবশ্য বাঁশি কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল রাধাকে।

সর্বশেষ অংশ হল রাধা বিরহ। এই অংশে রাধার নিদারুণ বিরহ দশা উপস্থিত হলো। 1 বিরহকাতরা রাধিকার নতুন রূপ আমরা দেখতে পাই। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় তাম্বুল খণ্ড থেকে বাণ খণ্ড পর্যন কৃষ্ণের্ত যে রূপের পরিচয় পেয়েছি সেখানে আর যাইহোক না কেন শোভনতা বা শালীনতা একান্ত অভাব আছে। পদাবলী সাহিত্যে আমরা যে রাধিকাকে পায় কৃষ্ণই তো তার সুখ সর্বস্বা, কৃষ্ণ অন্তপ্রাণ। রাধা প্রথম থেকেই তিল তুলসী দিয়ে কৃষ্ণের দেহ সমর্পণ করছেন। কিন্তু অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা প্রথম থেকেই প্রতিবাদী কৃষ্ণের আচরণের প্রতি, তৎসত্ত্বেও কৃষ্ণ তাকে প্রতিনিয়ত আহ্বান করেছে। এই আহ্বানে রাধা কোনরূপ সাড়া দেয়নি। সমস্ত প্রচলিত সামাজিক রুচি বা ধ্যান ধারণা দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় কৃষ্ণ প্রাথমিক ভাবে রাধার অভিষ্ট পূরণ করেছে। বিশেষ করে ভার খণ্ডে  বা ছত্র খণ্ডে, রাধার মনের পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। এখানেই একজন মানবী নারীকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি। যিনি প্রথম জীবনে বহু দুঃখ লাঞ্ছনা সহ্য করে যৌবনে পৌঁছেছে তবে তিনি কৃষ্ণ প্রেমের মহিমা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন।

রাধা বিরহ অংশে সেই সমগ্র নারীত্বের পূর্ণরূপ। এখানেও কৃষ্ণ তার অভিষ্ট পূরণ করেছে। কিন্তু রাধার মানবিক প্রেমকে কখনো মর্যাদা দেয়নি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবলই তার শারীরিক আকাঙ্ক্ষা নিবিত্ত করেছে। যে কৃষ্ণ নামে ভারতবর্ষে তথা ভারত সংস্কৃতি, গোটা বাংলাদেশ  নিমনা হয়ে পড়ে, শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে এই কৃষ্ণ সহ যোজন দূরত্ব। কিন্তু রাধা চরিত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। প্রাথমিকভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংযত হলেও শেষ পর্যন্ত রাধা কৃষ্ণের কাছে তার সর্বস্ব নিবেদন করেছে। সেই নিবেদনের মধ্যে কোথাও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা বহুবার কৃষ্ণের সঙ্গী সম্মিলিত হয়েও দেহজ বাসনা কামনা কে ভুলতে পারেনি। রাধার বাসনা বুঝি শেষ নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা যে মানবী। এটাই তার বড় প্রমাণ।

প্রমথনাথ বিশীর মতে;-" শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধার যেখানে শেষ, পদাবলীর রাধার সেখানে আরম্ভ"।

অমার্জিত রুচি, পরিপূর্ণভাবে গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট, অসংস্কৃত এই গ্রন্থে কৃষ্ণ চরিত্রের পাশে বড়ু চন্ডীদাস রাধা চরিত্রের যে অবকাশ সৃষ্টি করলেন তা অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে মানবিক। এখানেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধা চরিত্রের অভিনবত্ব।

1 comment:

  1. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও পদাবলির প্রেম দর্শনের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাই।

    ReplyDelete

Popular