Wednesday 4 April 2018

There Are Many Differences Between Srikrishnakirtan & Vaishnava Recitals/শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে নানান মিল-অমিল


"শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে নানান মিল-অমিল সত্বেও'রাধা বিরহ' অংশের দিকে লক্ষ্য রেখে রসিক সমালোচক কে অনুসরণ করে আমরা ও ও বলতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধার যেখানে শেষ, পদাবলী রাধার সেখানে আরম্ভ"।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য বৈষ্ণব পদাবলী উভয় ক্ষেত্রেই রাধা কৃষ্ণের প্রেম মূলক বিষয়বস্তু রূপে চির অদৃত। তবে বৈষ্ণব পদাবলী যেমন প্রাকচৈতন্য, চৈতন্য সমসাময়িক ও চৈতন্য উত্তর এই তিন পর্যায়ে বিন্যস্ত এবং প্রতিটি যুগের ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা তার মধ্যে লক্ষণীয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য কিন্তু তেমনটা নয়, কারণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য একজন কবির রচিত নির্দিষ্ট একটি আখ্যানকাব্য। আর বৈষ্ণব পদাবলী কয়েক শতাব্দী ব্যাপী অনেক অনেক কবি বা পদকর্তার রচিত বহু পদের সমষ্টি, তাই তা পদাবলী।

দেশ-কাল-সময় প্রেক্ষিতে এই দুই ধরনের রচনা স্বতন্ত্রতা লক্ষণীয়। বড়ু চণ্ডীদাস যেশ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য রচনা করেছেন তা চৈতন্য পূর্ববর্তী কালের রচনা। পক্ষান্তরে পদাবলী সাহিত্য প্রাকচৈতন্য চৈতন্য উত্তর যুগের ভিন্ন ভিন্ন কবিদের সৃষ্টি। এই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী চৈতন্য যুগের ব্যাপারটি কোন কাকতালীয় যোগমাত্র নয়, প্রাক্ চৈতন্য পর্বের কোন গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় দর্শনের প্রভাব শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মধ্যে ছিল না। কিন্তু পদাবলী সাহিত্য তা চৈতন্য পরবর্তী পর্বেতে বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য হিসাবে পরিগণিত হয় করা হয়।

মধ্যযুগের সব সাহিত্যই ছিল গেয়। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী উভয়ই গীত হত। উভয়েরই আবেদন ছিল রসিকজনের শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাছে। রাগ তাল ও লয়ের উল্লেখ উভয় ক্ষেত্রে লক্ষ্য করার মতো।

তবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য গ্রন্থে প্রতিটি চরিত্র ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে; যা বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে কখনোই তা সম্ভব হয়নি। বড়ু চন্ডীদাস ও বিষ্ণু পদকর্তারা রাধার বিরহিনী মূর্তি অংকনে অধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন- এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে বড়ু চন্ডীদাস তাঁর স্বাতন্ত্রতার পরিচয় পায়। তাঁর রাধা ধূলিমলিন ধরিত্রীর রক্তমাংসে গড়া মানবী। এ রাধার অঙ্গে অঙ্গে সুপরিচিত মাটির ঘ্রাণ। এ রাধা প্রথম থেকেই কৃষ্ণের প্রস্তাবে প্রতিবাদী, কৃষ্ণ তাঁকে বলপূর্বক অধিকার করেছেন। তাই বহু চন্ডীদাসের রাধা প্রথমে শ্যামবীত রাগিনী ও পরে তিব্র ও চুরান্ত রূপে অনুরাগিনী তে পরিণত হয়েছেন। এই অনুরাগিনী রাধার মধ্যে বিরহবেদনা সঞ্চারিত হয়ে পদাবলী রাধার সঙ্গে এক সমতলে স্থাপিত হয়েছেন তিনি। মিলন উল্লাসের অবসানে রাধার হৃদ-বৃন্দাবনে বেজেছে বিরহের বাঁশি। পদাবলী রাধার মতো বড়ুর রাধাও বংশীধ্বনি শ্রবণে ব্যাকুল হয়ে বলেছেন;-" আকুল শরীর মোর বে আকুল মন।/ বাঁশির শবঁদে মো আউলাইলোঁ রান্ধন"।। অর্থাৎ বংশী খণ্ড থেকেই এই রাধা কৃষ্ণের প্রতি পূর্ব বর্তায় অনুরক্ত হয়েছে। এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল ভারখন্ড থেকেই। বংশী খণ্ড ও রাধাবিরহ অংশে তা অপূর্ব ইতিবাচক পরিণতি। তা সত্ত্বেও এই রাধা শেষপর্যন্ত মানবী। মোটকথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা লৌকিক নায়িকা। তারমধ্যে ভাব-বৃন্দাবনের যোগিনীপারা রাধার স্তিমিত আভাস হয়তো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভাবনবলতার প্রৌঢ় 'পারাবতী' হতে সে পারিনি। তাই আমরা বলতে পারি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা'পূর্ব রাধা' ও বৈষ্ণব পদাবলির রাধা'উত্তর রাধা'। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী উভয়ই রাধা কৃষ্ণলীলায় সমুজ্জ্বল।

অন্যদিকে কৃষ্ণচরিত্রের মধ্যেও গভীর স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়। পদাবলীর কৃষ্ণ আভীর পল্লীর কোন এক অমার্জিত, অশালীন যুবক নয়; এ কৃষ্ণ গরিমাময় এবং ভক্তের আবেদনের প্রতি সম্ভ্রমশীল চরিত্র। শুধু রাধা তার কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলেন না, দৃঢ় আক্লেশে, অনায়াসে পরম আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসেন রাধার কাছে;" দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরই দেবতা"। এই গরিমা, এই ভাব-সন্ধ্যার ভাব মাধুর্য্যময় মধুর রসের এই ঘন সংবদ্ধ রূপ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রে তা অপ্রতিফলিত ঘটেছে দেখা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃষ্ণ চতুর নাটোরের মত। ছলে-বলে-কৌশলে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে প্রথম থেকেই রাধাকে অধিকার করার জন্য উন্মুখ। কবি বড়ু চন্ডিদাস কৃষ্ণ চরিত্র পরিকল্পনা ও তার চিত্রায়নে কবি মৌলিকতা ও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় বজায় রেখেছেন পদাবলী সাহিত্য থেকে।

পদাবলী সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষাও ভাবের কোন কোন জায়গায মিল যে় ধরা পড়ে না, তা কিন্তু নয়। কৃষ্ণের বাঁশি রাধা কে উন্মনা করে তুলেছে, বাঁশির ধ্বনিতে রাধা যে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিল তা দু জায়গাতেই রয়েছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভঙ্গি বা Approach বস্তুটাই আলাদা। তার মূল কথা হল প্রেম নয়, দুঃখের মধ্যদিয়েই ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া নয়, তা শুধুই ছলে-বলে-কৌশলে আকাঙ্ক্ষিত নারীর শরীর দহন করা। পদাবলী সাহিত্যে যে মাধুর্যের মূর্ছনায় ধূলুণ্ঠিত হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তা আমরা কল্পনা করতে পারিনা।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একইসঙ্গে গীতিধর্মী ও নাট্যধর্মী; আর বৈষ্ণব পদাবলী তত্ত্বের আধারে হলেও মূলত গীতিধর্মী। পদাবলীর জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপক, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তা থাকার কথা নয়। সাধারণ কতকগুলি ঘটনা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নাট্যধর্মিতার প্রাধান্য বড়ু চন্ডীদাসের কাব্যে দেখা যায়।শেষ পর্যন্ত বলা যেতে পারে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের প্রেম কথার অন্তরালে যে ভাবভাবনা বহমান তা গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী। অপরদিকে, পরচৈতন্য বৈষ্ণব পদাবলী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনানুসারী। পদাবলীতে রাধার মধ্যে আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইছা নয়,  কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছায়  মূখ্য। অর্থাৎ আমরা পুনরাবৃত্তি করে বলতে পারি সবচেয়ে বড় কথা বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য তা একেবারেই নয় যদিও সেখানে রাধা ও কৃষ্ণের কথাই পরিবেশিত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

Popular