Saturday 24 March 2018

Turkish Invasion Of Bengal & Its Consequence / বাংলায় তুর্কী আক্রমণ ও তার ফলশ্রুতি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। এর রচনাকাল খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। চর্যাপদের পর প্রায় আড়াইশো বছর বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। আর এই বাংলা সাহিত্যের বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ হিসাবে তুর্কী আক্রমণকেই দায়ী করা হয়। এই তুর্কী আক্রমণ বাংলায় কোন আকস্মিক ঘটনা বা ভাগ্যের পরিহাস নয়- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনিবার্য পরিণাম। দ্বাদশ শতাব্দী শেষার্ধে তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজী বিহার ও বাংলাদেশ বিজয়ের জন্য অভিযান শুরু করেন এবং ত্রয়োদশ শতকের একেবারে প্রথমে বাংলাদেশের সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তুর্কীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলপূর্বক অপরকে ধর্মান্তরিত করা, অপরের সংস্কৃতিকে বিধ্বস্ত করা। তারা ছিল ধর্মোন্মাদ, যুদ্ধবাজ ও সাহসী। তারা হিন্দু দেবদেবীর মঠ, মন্দির, শিক্ষায়তন, দেবমূর্তি প্রভৃতি ধ্বংস করে মসজিদ ও মুসলিম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয় নর-নারী নির্যাতন, হত্যা, গৃহদাহ প্রভৃতির মাধ্যমে তুর্কীরা ভয়াবহ তুর্কী নাচন শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন;-" বখতিয়ারের নবদ্দীপ জয় এবং একশত বৎসর মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়িয়া মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়, ভাগ্যের পরিহাস ও নয়-  রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনির্বায পরিণাম"।।

তুর্কী বিজয়ের ফলশ্রুতি: সামাজিক পরিণাম:-

তুর্কী আক্রমণের প্রচণ্ড আঘাতে বাঙালির জীবন নানাদিক থেকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে একথা ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সমাজ জীবনে এর সুফল ফলতে থাকে।

(ক) সামাজিক ভেদাভেদ:-

সেন রাজবংশের সময় দেশে কৌলিন্য প্রথা, বর্ণভেদ, জাতিভেদ, খুব কঠোর ভাবে বিদ্যমান ছিল। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য,  প্রায়শ্চিত্ত ও সংস্কার সেন যুগেই ব্যাপকভাবে প্রসারতা লাভ করে। বাঙালি সমাজে শ্রেণীবিভাগ থাকায় তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দের সঙ্গে নিম্ন শ্রেণীরদের কোন হৃদয়ের সংযোগ ছিল না। ফলে নিম্নবর্গের লোকেরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ইসলামের নব্য মানবতার পরিচয় পেয়ে এই ধর্মের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।

(খ) হিন্দু সমাজের সুস্পষ্ট বিভেদ:-

শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষেরা সে যুগের কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। এদের আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বণ, সংস্কৃতির সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীর আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বণ বা সংস্কৃতির কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলনা। ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভেদ নীতি গড়ে উঠেছিল।

(গ) অখন্ড বাঙালি জাতি:-

তুর্কী বিজয়ের ফলে বিজয়ী রাজশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে অভিজাতরা সব বিভেদ, বিচ্ছেদ অবজ্ঞাকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষার কাজে এগিয়ে গেলেন। রাষ্ট্রিক ঘূর্ণিঝড়ে আলোড়িত বাঙালি জাতি আর্য অনার্য, উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একত্রে মিলিত হয়ে এক অখণ্ড বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার সুযোগ পেল। ডঃ সুকুমার সেনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন;-" আর্য- অনার্যের মধ্যে সংস্কৃতিগত ধর্মবিশ্বাসগত আচার-ব্যবহারগত ও ভাবধারাগত এইযে স্তরভেদ ইহা বিলুপ্ত হইয়া অখন্ড বাঙালি জাতি গঠিত হইয়া উঠিবার পক্ষে একটি প্রধান বস্তুর অভাব ছিল, দ্বিতীয় পক্ষের সংঘাত"।

(ঘ) হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি:-

তুর্কী আক্রমণের ফলে কেবল উচ্চ-নিম্ন বর্ণভেদ তৈরি হয়েছিল তা নয়, হিন্দু মুসলিমদের মিলন ও সাধিত হয়েছিল। দুটি স্বাতন্ত্র সভ্যতা পরস্পরের সংস্পর্শে এসে পরস্পরকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে। এবং স্বাভাবিকভাবে বাঙালি জীবনযাত্রা নানাভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, ভাষা সংস্কৃতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ-বর্জন নীতিতে নতুনত্ব প্রকাশিত হতে শুরু করল।

(ঙ) বাঙালি সমাজে অর্থনীতি প্রাধান্য:-

তুর্কী বিজয়ের পরে ভারতীয় জনজীবনের সঙ্গে যোগসূত্রে বাংলার কৃষিজ, শিল্পজাত সম্পদ বাঙলার বাইরে বিক্রিত হয়ে অর্থনীতিতে নতুন দিকের সূচনা করলো। কৃষিজীবী থেকে বহির্বাণিজ্য এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যা বাংলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম ধীরে ধীরে নগরে পরিণত হল।

(চ) হিন্দুত্ব বোধ সৃষ্টি:-

তুর্কী বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতিরূপে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম হিন্দুত্ব বোধ জাগ্রত হল। তুর্কী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায়"হিন্দু" নাম সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতির পরিচয়, উপাধি, বাংলা স্থানের নাম প্রভৃতি বিষয়ে তুর্কী বিজয়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তুর্কী বিজয়ের ফলশ্রুতি: সাহিত্যের প্রভাব:-

(ক) মঙ্গলকাব্যের শাখা:-

তুর্কী বিজয়ের বহুমুখী প্রভাবের অন্যতম হলো সাহিত্যের নতুন চেতনার প্রকাশ। তুর্কী শাসনকালে অর্থাৎ অন্ধকার যুগে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ বিপদ থেকে ত্রাণের জন্য মনষা-চণ্ডী ইত্যাদি দেবদেবীর কল্পনা করেছেন। পরবর্তীকালে এই সমস্ত লোকায়তিক দেবতা ক্রমশ উন্নততর হয়ে মঙ্গলকাব্যের দেবতারূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো। রাষ্ট্রীয় অভিঘাতের আকস্মিক দিক প্রকাশ অনন্যপায় উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের অনেক অনার্য দেবদেবীকে স্বীকার করে নিল। উচ্চ-নিম্ন বর্ণের এই সহজ যোগাযোগের ফলে মঙ্গলকাব্য নামক কাব্য ধারাটি শিল্পসম্মত রুপ পেয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক আশ্চর্য সংযোজন রূপে প্রকাশ হলো।

(খ) অনুবাদ সাহিত্য শাখা:-

এই নবগঠিত বাঙালি জাতির সামনে সর্বভারতীয় পৌরাণিক হিন্দুত্বের একটি আদর্শকে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভূতি হয়েছিল; রামায়ণ,  মহাভারত ও ভাগবতের কাহিনী অনুবাদের বাসনা এমনইভাবে জন্ম নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ডঃ দীনেশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন;-" মুসলমান, ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন"। অন্ধকার পর্বের অর্থাৎ ( ১২০১-১৪০০ ) প্রায় দুশো বছরে যেমন মঙ্গল দেব দেবীর পূজার্চ্চনার বিস্তার ঘটিয়েছে, তেমনি অপৌরাণিক জনসংস্কৃতির মর্জ্জায় রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে পুরাণ কাহিনীর রস প্রবেশ করেছে। পৌরাণিক হিন্দুধর্মের আদর্শ সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে এই তথ্যগুলি অনুবাদের প্রয়োজন দেখা দিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সূচনায় ছিল ধর্মীয় সংস্কৃতিক ও প্রতিরোধের সাহিত্য। বলা যেতে পারে নব্য গঠিত বাঙালি জাতি বিশিষ্ট রূপে আত্মপ্রকাশের সাহিত্য।

সুতরাং এইভাবেই তুর্কী আক্রমণের ফলেই বাংলা সমাজে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মিলন হয়েছিল তেমনি হিন্দু-মুসলিম জাতির সমন্বয় ও ও সাধিত হয়েছে একান্ত সহজভাবে। শুধু তাই নয়, এরই ফল স্বরূপে সাংস্কৃতিক জীবনের বিস্তৃত বিকাশ ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে। নতুন ভাবে জেগেছে সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা। তাই ঐতিহাসিক দিক থেকে তুর্কী আক্রমণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।।

No comments:

Post a Comment

Popular