Tuesday 10 April 2018

विद्यापति / বিদ্যাপতির পদাবলী

বিদ্যাপতির পদাবলী:

জয়দেব বাঙালি হয়েও ভারতের অবাঙালি সমাজে যেমন অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, বিদ্যাপতি অবাঙালি হয়ে তেমনই বাঙালি সমাজে অসামান্য সমাদর লাভ করেছেন। তিনি মিথিলার অর্থাৎ উত্তর বিহারে অধিবাসী অথচ বাংলাদেশেই বাঙালিরা প্রথমমেই তাঁর পদ সংগ্রহ করে তাঁর কবি কর্মের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে গিয়েছেন। বিদ্যাপতি বাঙালি সমাজে কত বড় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তার পরিমাণ নির্ণয় করতে গেলে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু থেকে শুরু করে আধুনিক কালের রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই বিদ্যাপতি সঙ্গে নিজেদের অন্তরের একটা নিগূঢ় যোগসূত্র কল্পনা করে তাঁর পদাবলীর মাধুর্যকে আস্বাদন করেছেন। বাঙালি তাকে 'মৈথিল কোকিল', 'কবিকুলচন্দ','রসিক সুভাভূষণ সুখকন্দ','রসধাম','কবিপতি','কবি-সার্বভৌম' ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করে কৃতার্থ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে নিজেকে উদার কাব্যরসিক হিসেবে সপ্রমাণিত করেছে।

বিদ্যাপতির আর্বিভাব কাল:

বিদ্যাপতির আর্বিভাব কাল নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সে সম্পর্কে সঠিক ভাবে কিছু জানা যায়নি। বিদ্যাপতির পূর্বপুরুষগণ মিথিলার রাজবংশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেজন্য মিথিলার রাজবংশের ইতিহাস থেকে বিদ্যাপতির কালনির্ণায়ক কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সন-তারিখের নানা বৈষম্য ও ক্রুটি বিদ্যমান থাকার কারণে নিঃসংশয় ভাবে গ্রহন করা যায় না। এছাড়াও বিদ্যাপতির মৈথিলী পদাবলী ও অবহট্ট ভাষায় রচিত গ্রন্থের মধ্যে তৎকালীন ঐতিহাসিক ঘটনার কিছু কিছু উল্লেখ দেখা যায়। তবে পদাবলী থেকে বিদ্যাপতির আর্বিভাব কাল সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যেতে পারে। এছাড়াও বিদ্যাপতির সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে নানা রাজবংশের উল্লেখ আছে, কোথায় ও বা তিনি সন-তারিখের ব্যবহার করেছেন। এগুলি কবির আর্বিভাব কাল নির্ণয়ে একটু সাহায্য করে।

বিদ্যাপতির একটি পদের ভূমিকাতে রায় নসরত-এর নামোল্লেখ দেখা যায়;-"কবিশেখর ভণ অপরূব রূপ দেখি।/রাএ নসরদ সাহ ভজলি কমলমুখি"।।

রায় নসরত ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দ জৌনপুর অধিকার করেন এবং১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। কাজেই অনুমান করা যেতে পারে বিদ্যাপতি চতুর্দশ শতকের শেষভাগে বর্তমান ছিলেন।

বিদ্যাপতির জীবনকথা:

বিদ্যাপতির জীবনকথা সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু জানা যায় না। তবে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, গিয়ার্সন প্রমুখ পণ্ডিতগণ কর্তৃক আহৃত তথ্যপঞ্জি থেকে কবি বিদ্যাপতির ব্যক্তিজীবনের কিছুটা তথ্য পাওয়া যায়। বিদ্যাপতি দ্বারভঙ্গা জেলার অন্তর্গত বিসফী গ্রামের এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম গণপতি। তাদের কৌলিক উপাধি হলো ঠাকুর। পুরুষানুক্রমে তাঁরা মিথিলার রাজবংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কবির পূর্বপুরুষগণ সকলেই মিথিলার রাজসভায় উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।তাঁর পিতামহ জয় দত্তের আমল থেকে বিদ্যাশিক্ষার দিকে তাদের বংশের মোর ফেরে। বিদ্যাপতির পিতা গণপতির সময় অবশ্য বংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। তথাপি ঠাকুর বংশের ঐতিহ্য গুনে বিদ্যাপতি মিথিলার রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

বিদ্যাপতি মৈথিলী ভাষায় যে পদাবলী রচনা করেন এবং অবহট্ট ভাষায়'কীর্তিলতা'নামে যে গদ্য-পদ্যময় চম্পুকাব্য প্রণয়ন করেন, তা থেকে তাঁর জীবনকথা সম্পর্কে কিছু পরিচয় লাভ করা যায়। কীর্তিলতা তে বিদ্যাপতি'ওইনীবার' ব্রাহ্মণ বংশের কীর্তিকথা উল্লেখ করেন। ঐ বংশের রাজা গগনেশ্বর ১৩৭২ খ্রিস্টাব্দে অসলান নামক এক মুসলমানের কাছে পরাভূত হয়ে নিহত হন। তখন তাঁর দুই পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ দেশত্যাগ করে জৌনপুরে চলে যান এবং সেখানকার শাসনকর্তা ইব্রাহিম শাহের সহায়তায় তাঁরা অসলান কে পরাজিত করেন। কীর্তিসিংহ এরপর রাজা হন। এই রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি'কীর্তিলতা' কাব্য প্রণয়ন করেন। কীর্তিসিংহ এর মৃত্যুর পর তাঁর পিতৃব্য দেবসিংহ সিংহাসন লাভ করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি 'ভূপরিক্রমা' গ্রন্থ রচনা করেন।দেবসিংহের পর তাঁর পুত্র শিবসিংহ অল্পকালের জন্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। তারই উৎসাহে বিদ্যাপতি অবহট্ট ভাষায়'কীর্তিপতাকা' ও সংস্কৃতে 'পুরুষপরীক্ষা' রচনা করেন। শিবসিংহের পর তাঁর ভ্রাতা পদ্মসিংহ রাজা হন। তাঁর পত্নী বিশ্বাস দেবীই রাজ্য পরিচালনা করতেন। কবি বিশ্বাস দেবীর নির্দেশেই'শৈবসর্বস্বসার' এবং'গঙ্গাবাক্যাবলী' রচনা করেন। এরপর বিদ্যাপতি ওই বংশের নরসিংহের নির্দেশে'বিভাগসার','লিখনাবলী' এবং ভৈরব সিংহের নির্দেশে'দুর্গাভক্তি' তরঙ্গিনী রচনা করেন। এসকল তথ্যপঞ্জি থেকে বোঝা যায় বিদ্যাপতি আজীবনকাল মিথিলা রাজবংশের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এসেছেন। রাজবংশের সাহচর্যে এসে বিদ্যাপতি যে প্রভূত ধনমান অর্জন করেছিলেন তাঁর পরিচয় পাওয়া যায় শিবসিংহের তাম্রপাত্রে উৎকীর্ণ দান-পত্রে। এই কারণেই বিদ্যাপতিকে'অভিনব জয়দেব' নামে অভিহিত করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

Popular