Friday 6 April 2018

Krishna Character Of Srikrishnakirtan/ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণচরিত্রের অভিনবত্ব


 শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণচরিত্রের অভিনবত্ব:

দীর্ঘকাল ধরে পদাবলী সাহিত্য পাঠের সূত্রে কৃষ্ণচরিত্রের যে মহিমান্বিত, প্রেমিক অথচ সম্ভ্রম উদ্রেককারী ব্যক্তি হিসাবে কৃষ্ণ চরিত্রের যে দৈব মহিমা বাঙালি পাঠক পরিচিত হয়েছে, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কৃষ্ণ চরিত্রের সঙ্গে তা কোন সাদৃশ্য নেই। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে জন্ম খন্ডে কৃষ্ণের আর্বিভাবের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যে কারণ দেখানো হয়েছে সেখানে কিন্তু পৌরাণিক মহিমার অবকাশ ছিল। কবি আমাদের জানিয়েছেন;-"কংসের কারণে হ এ সৃষ্টির বিনাশে"। কংস নিধনের কারণে বিষ্ণুর স্বয়ং কৃষ্ণ রূপে মর্তে আর্বিভাব এবং দেবী লক্ষ্মী রাধা রূপে মর্তে আগমন হয়েছে। কিন্তু এই পর্যন্তই তাম্বুল খন্ড থেকে রাধাবিরহ অংশ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনীর যে বিস্তার সেখানে কিন্তু এই সম্ভ্রমযুক্ত পৌরাণিক দৈব মহিমার কোনো অবকাশ নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে যে কৃষ্ণকে আমরা পেয়েছি তিনি মথুরা-বৃন্দাবনের আদিম পল্লীর এক রুচিহীন অবাঞ্চিত গো-তরুণ। অর্থাৎ বলা যেতে পারে জন্ম খন্ড এবং যমুনা খণ্ডে কিছু পুরাণ কথা ছাড়া এ কৃষ্ণের কোথাও দেবত্বের এতটুকুও অবকাশ দেখা যায় না।

তাম্বুল খণ্ডে আমরা শ্রীকৃষ্ণকে পাই, রাধা সম্ভোগের প্রতি তাঁর অধিক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। বড়াই বনমধ্যে রাধাকে হারিয়ে কৃষ্ণের কাছে শরনাপন্ন হলে কৃষ্ণ চতুরতার দ্বারা বড়ায়িকে রাধার রূপের বর্ণনা করতে বলেন;-"উদ্দেশ বুলিব মঁবে রাধিকার আহ্মে।/তঁবে ভালমঁতে তার রূপ কহ তোহ্মে"।। রাধার রূপের কথা শুনে কৃষ্ণ রাধার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বড়ায়ির মাধ্যমে কর্পূর মিশ্রিত তাম্বুলসহ প্রেম প্রস্তাব প্রেরণ করেন। কিন্তু রাধা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এবং আমাদের জানিয়ে দেয় সে পরপুরুষের স্ত্রী। ভদ্রতার অবকাশ থাকলে, রুচি স্নিগ্ধ মনের অধিকারী হলে কৃষ্ণ এরপরে অপ্রসন্ন হতেন না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ছলা-কলার আশ্রয় নিয়েছে।

তারই ফলশ্রুতিতে দানখণ্ডে রাধার পথ অবরোধ করে কানু প্রথমে তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশষণ করেন অতি নির্লজ্জভাবে এবং তার কাছে বারো-বছরের দান চেয়ে বসেছে। রাধা যৌবন অধিকারের জন্য আত্মম্ভরিতা ও আত্মস্ফালন তিনি কম করেননি;-"তোর কংসে মোর কিছু করিতেঁ না পারে।/তোহ্মারি সে রূপেঁ মোরে মরিবারে পারে"।।

কৃষ্ণের এরকম আত্ম অহমিকা প্রকাশক উক্তি দানখন্ডে প্রচুর আছে। রাধার সমস্ত অনুরোধ, অনুনয় উপেক্ষা করে অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণ তাকে বলপূর্বক সম্ভোগের আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ করেছে।

নৌকাখণ্ডে দেখি একইভাবে কৃষ্ণ ঘাটিয়াল এর বেশ ধারণ করে যমুনার ঘাটে রাধার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাধার সমস্ত সখীদের পরপার করবার পর একা রাধাকে নৌকায় তুলে মিলনের প্রস্তাব দিলেন কৃষ্ণ। নৌকাডুবি করিয়ে রাধার প্রাথমিকভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কৃষ্ণ জল-বিহারে মেতে উঠেছে।

ভারখন্ডে অবশ্য রাধার চাতুুরির কাছে কৃষ্ণকে হার মানতে হয়েছে। সেই সঙ্গে নিজের মর্যাদাহানির বেদনা ও লজ্জা যুক্ত হয়েছে। এই খণ্ডে মিলনের আশা দিয়ে ও রাধা তা রক্ষা করতে পারেন পারিনি।

ফলে ছত্রখণ্ডে দেখি'কোপিল কাহ্নাঞি'রাধার সঙ্গ ছাড়ছেন না। কিন্তু রাধা ও সহজে ছাড়ার পাত্রী নন। শেষ পর্যন্ত রাধা রতিদানের সম্মত হন কিন্তু একটি শর্তে। বড়ায়ি কৃষ্ণকে সেই শর্তের কথা জানায়;-"তোর ভাগেঁ দিল রাধা রতি অনুমতী।/হরিষ করিআঁ তার মাথে ধর ছাতী"।।

পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ বৃন্দাবন খন্ডে আমরা দেখি কৃষ্ণের আকুলতা রাধাকে পাবার যে কৌশল ও অভিষ্ট সিদ্ধতে সক্ষম হয়েছে। রাধাকে দেওয়া পরামর্শ অনুসারে কৃষ্ণ অনান্য গো-বধূদের ঘর থেকে বার করে এনেছে তা তৈরি উদ্যানে।

♦কিন্তু বৃন্দাবন খন্ডের এই ঘটনার পর ও এই গ্রামীন প্রেমিকের স্থূল আচরণ আমাদের বারবার আহত করে। হারখণ্ডে এই কৃষ্ণই রাধার হার চুরি করেও রাধার অভিযোগকেও অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, রাধার চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ ও অক্লেশে উচ্চারণ করেছে যশোদার কাছে।

পরবর্তী বাণখণ্ডে তারই প্রতিক্রিয়ায় আর বড়ায়ির প্ররোচনায় কৃষ্ণ-রাধার প্রতি নিষ্ঠুর বাণ নিক্ষেপ করেছেন। কিন্তু এরপর ব্যাকুল আর্ত কৃষ্ণ-রাধার জন্য ক্রন্দন করেছে। এক সময় কৃষ্ণের মুখে উচ্চারিত হয়েছে;-"আহ্মার জীবন রহে তোহ্মার জীবনে"।। এই একটি কথাই যেন এক পলকে সমস্ত রূঢ়তা আর স্থুলতার আবরণ সরিয়ে কৃষ্ণের প্রেমিক সত্তাকে উন্মোচিত করে।

আবার বংশীখণ্ডে কৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়ে রাধাকে উন্মাদিনী করে তুলেছে।

রাধাবিরহ অংশে দেখি কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে আবার মিলিত হয়েছে। মিলিত হওয়া সত্বেও প্রেমের আবহ তেমন সৃষ্টি হয়নি। রাধা সম্পর্কে তিনি অশালীন শব্দের প্রয়োগ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে চলে গেছে।সূচনায় রাধা যাই থাকুক না কেন, এখন তিনি শুধুমাত্র  কৃষ্ণ সমর্পিত প্রাণা। এখন তার মন ও শরীর শুধুমাত্র কৃষ্ণের জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে। অথচ চতুর নাটোরের মত কৃষ্ণ তার ইচ্ছা পূরণ  করেও রাধার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক রাখেনি। 

সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পুরুষের ক্ষেত্রে এই সামাজিক অন্যায় আমরা প্রত্যক্ষ করি। কৃষ্ণের আচরণের মধ্য দিয়েই তারই পুনরাবৃত্তি সেখানে আর যাই থাক, তথাকথিত দেবত্বের চিহ্নমাত্র নেই। একান্তভাবেই বিশেষ করে লৌকিক সংস্কৃতি অবলম্বন করে কৃষ্ণকে সৃষ্টি করলেন বড়ু চন্ডীদাস। পরবর্তীকালে রচিত পদাবলী সাহিত্যে কৃষ্ণ অপ্রাকৃত ভাব-বৃন্দাবনের চিরকিশোর প্রেমিক। জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'এর নায়কের মতোই মূর্তিয়মান'উজ্জ্বলনীলমণি'। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃষ্ণ তাঁর অজস্র উৎকট অসঙ্গতি নিয়েও শিল্পীর হাতে আঁকা জীবন্ত মানুষ।

No comments:

Post a Comment

Popular