Saturday 31 March 2018

Reflection of Society in Sri KrishnaKirtan/শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সমাজের প্রতিফলন


শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সমাজের প্রতিফলন

সাহিত্য মূলত সামাজিক চৈতন্যের প্রকাশ। সামাজিক চিন্তাচেতনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় দেশকালের বিশিষ্ট পটে। শুধু কল্পনাবিলাস বৈভব মন্ডিত সাহিত্য হতে পারে না, তার মূল বাস্তবের মাটিতে প্রোথিত থাকে। আধুনিক কালে যে অর্থে সাহিত্যের মধ্যে আমরা সমাজ চিত্রের প্রতিফলন পাই, এমনকি মধ্যযুগে ও মঙ্গলকাব্য গুলিতে পেয়েছি, ঠিক সেই অর্থে বড়ুর রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তা মেলা ভার। অর্থাৎ বাংলাদেশে আন্তঃ সামাজিক প্রতিফলন কিভাবে বড়ুর কাব্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। কোন প্রত্যক্ষ সামাজিক চিত্র আমরা পাইনা। বলা যেতে পারে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ ও রাধার পারস্পারিক সম্পর্ক তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ ও জীবন বিস্তৃত পরিসরে প্রতিফলিত হয়েছে।

রাধার স্বামী, শাশুড়ি প্রভৃতিদের নিয়ে একটি পারিবারিক পরিবেশেই এই কাব্যের জন্ম খন্ড থেকেই তা চিত্রিত। সমাজে তখন বাল্য বিবাহ প্রচলিত ছিল। রাধা ও অতি অল্প বয়সেই আইহনের ঘরনী হলেন। 'বাঢ়ে তনুলীলা'- যৌবনে পরিণত হয়ে ও রাধার মধ্যে সতিত্বের গর্ববোধ ছিল। কৃষ্ণ যেভাবে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বলপূর্বক অধিকার বিস্তৃত করেছে তাকে তার মধ্যে দিয়েও সেদিনকার সমাজের অত্যাচারী বলযোগ্যতার ছবি একেবারে তা আড়াল থাকে না। তৎকালীন সমাজের নারীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ কাউকে নিযুক্ত করত, আমার ক্ষেত্রেও তাই হল;-"বড়ায়ি দেহ এহার পাশে", সমাজের এই অসৎ দূতিগিরি চরিত্র বড়ায়িকে আমরা দেখতে পাই।

মধ্যযুগে নারীর জীবন নানা দিক থেকেই শৃঙ্খলিত ছিল। তাদের স্বাধীন ইচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। এরই মধ্য দিয়ে আমরা এই কাব্যের বিভিন্ন জীবিকার মানুষদের দেখতে পাই। জীবিকার প্রয়োজনে গোপ পরিবারের বধুরা দই-দুধের পসরা নিয়ে হাটে যেত। ঘরের কাজের পাশাপাশি তারা বাইরের কাজ করত। নইলে তাম্বুল খণ্ডে বড়ায়ের মুখে শুনবো কেন;-"চিরকাল দধি দুধ ঘরে না হ এ।/এঁবে মথুরার হাট জাইতেঁ জু আএ"।। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পটভূমি হিসেবে যে সমাজ জীবন উপস্থিত- তার একটি হলো পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পুষ্ট ভাবধারা, আর অপরটি হল- লোকায়ত সংস্কৃতির পুষ্ট একটি সমাজ সংস্কার। বিশেষ করে বাংলার লোকায়ত জীবনই এখানে প্রায় একমাত্র প্রাধান্য পেয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে মানবসমাজে ও সংস্কৃতির আটপৌরে দিক নিয়ে সাধারণ মানুষের যে বৃত্তি নির্ভর জনজীবনের বিস্তৃত পরিচয় বা তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলি যে শুধুমাত্র সমাজ সম্বন্ধীয় নয়- পরোক্ষভাবে তা ঘটনা বিবৃত। বৃত্তি কেন্দ্রিক নানা প্রসঙ্গ পেলেও গ্রন্থ মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, নমঃশূদ্র, কুমার, তেলি, নাপিত, বৈদ্য, কান্ডারী, সাপুড়ে, জাদুকর প্রভৃতি নানা জাতি তাদের বৃত্তি নির্ভর প্রসঙ্গ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে উল্লিখিত। বাংলার সামাজিক বর্ণনা বিস্তারের এই ছবি চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ও তা সত্যতা অর্জন করেছিল। সেই একই সঙ্গে আমরা বড়ুর কাব্যে পায় তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে। শুধু তাই নয়, সাধারণ ভিখারীর প্রসঙ্গ পাই, তেমনি আমার 'খাপর' বা 'নরকপাল' হতে যোগিনীর ভিক্ষাবৃত্তির বিষয় ও বর্ণিত হয়েছে এই কাব্যে। ব্যবহারিক জীবনচর্যার দৈনন্দিন দিক অর্থাৎ আহার বিহার, বেশভূষা, চালচলন প্রভৃতি বিষয়ে ও ও কবি অভ্যাস ও সংস্কার কে ঘিরে বিভিন্ন উপাদান আহরণ করেছেন;-"আগর চন্দন আঙ্গে মাখি/ কাজলে রঞ্জিল দুঈ আঁখি।।/হেন নেহ বড়ায়ির  উদ্দেশে।/ চলি গেলি রাধিকা হরিষে।।/ ফুলে জড়ী বান্ধি কেশপাশে।/ পরিধান কর নেত  বাসে।। (রাধা বিরহ,১৭)


শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যের মধ্যে সেকালের সমাজে অলংকরণ, কেশ বিন্যাস, ইত্যাদির কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। সে যুগের মেয়েরা যে কানে কুন্ডল,হাতের কাকন চুড়ি পরত তা রাধিকার সাজসজ্জা থেকে অনুমান করা যায়।

(১) "কন্নত কুন্ডল হিরার ধার"।

(২)"বাহুতে কনক চুড়ি,মুক্তা রতনে জড়ি/রতন  কঙ্কন করমূলে"।।

শুধু এ কাব্যে রাধা বা অন্য কোন মেয়ে নয়, কৃষ্ণ কেও অনুরূপভাবে অলঙ্কারে ভূষিত করেছে। অনেক সমালোচকদের মতে সেদিনকার সমাজের যে স্বচ্ছ বা সম্ভ্রম জীবন ছিল, তারই প্রতিফলন দেখা যায়।

লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, সামাজিক প্রথা, বিধি-বিধান, আচার-রীতি ইত্যাদি বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছে এই কাব্যে। তাম্বুল খণ্ডে বড়ায়ি কর্পূর-তাম্বুল সহ কৃষ্ণের প্রেম প্রস্তাব রাধার কাছে বহন করে নিয়ে গেছে। শুভ সংবাদ, বা প্রেম প্রস্তাব পাঠানোর এটাই বোধ হয় সামাজিক প্রথা বা রীতি ছিল। নানাবিধ উৎসব অনুষ্ঠানের পশ্চাৎপটে নান্দনিক ভাবনা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কখনো ও মাঙ্গলিক কারণে কলাগাছ পুঁতি, কখনোও বা প্রথা অনুসারে পূর্ণ ঘট পেতে মঙ্গল কামনা আজকের দিনেও এক পরিচিত সামাজিক প্রথা।

আবার এই সংস্কারের পিছনেও সে সময় অন্ধ সংস্কার বা অশুভ লক্ষণ এর দৃষ্টান্ত প্রচুর আছে। শুভ-অশুভক্ষণ যাত্রা করার সংস্কার আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। হাঁচি, টিকটিকি ডাক, হোঁচট, শূন্য কলসি দরশন, ভিক্ষারত যোগিনী কে দেখা, কাকের ডাক- প্রভৃতি অন্ধ সংস্কার বিদ্যমান ছিল। এই অযাত্রা দর্শনের ফলে আজ রাধা ও কৃষ্ণের কাছে তিরস্কৃত হচ্ছে;-"আজি জখনে মোঁ বাঢ়ায়িলোঁ পা এ"।/পাঁছে ডাক দিল কালিনী মা এ"।।

এখানে রাধার উক্তিতে পিছুডাক জনিত সংস্কারের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা অশুভ বা আযাত্রা সূচক বলে আমরা আজও বিশ্বাস করি। আবার বিপরীতভাবে ও বলা যায় যে, দধি মঙ্গলের প্রতীক কিংবা বাছুরের সঙ্গী গাভীর দর্শন এইগুলি যে শুভ চিহ্ন তা এই কাব্যে আছে। অর্থাৎ মঙ্গল-অমঙ্গলের সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে যে জীবন চর্চা আমরা অনুসরণ করে চলেছি এখনো পর্যন্ত যা লুপ্ত হয়নি। তার পূর্ব প্রসঙ্গ এই প্রাচীন কাব্য গুলির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। সুতারাং এদিক দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমকালীন বাঙালি জীবনের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে অনেকটাই জায়গা জুড়ে আছে। এই ভাবেই গোটা কাব্য জুড়েই বাঙালির ভাব চেতনা ও জীবন-রসবোধ তৎকালীন সমাজ জীবনের খন্ড খন্ড উপস্থাপনায় পষ্টোজ্জল হয়ে উঠেছে।



Thursday 29 March 2018

Radha Character of Srikrishna Krittan / রাধা চরিত্র

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা এবং পদাবলী সাহিত্যের রাধা কি এক? রাধা চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা কর।

পদাবলী সাহিত্যে যে রাধা চরিত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেই অর্থে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা তার থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। পদাবলীর রাধা ভাব-বৃন্দাবনের অধিবাসিনী। প্রথম থেকেই সেই জন্যই যোগিনী সেজে কৃষ্ণের উপাসনা শুরু করেছেন। তাঁর মধ্যে প্রেমের প্রথম বিস্ময় চাঞ্চল্য নেই। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা প্রকৃতপক্ষে মানবী। একই সঙ্গে একথা বলবার যোগ্য, পদাবলী সাহিত্যে রাধার যে উপান্তর ভাগে ব্যঞ্জনা সর্বাংশে বিদ্যমান, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে মানবিকতা থেকে সদ্ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সূচনা তাম্বুল খণ্ডে। এই খণ্ড কাব্যের ভাগবত উপক্রমণিকা বটে। রাধাকৃষ্ণের আচরণ প্রকৃত নরনারীর পর্যায়ে নেমে এলো। রাধা সব সখিজনদের সঙ্গে মিলে বড়াই কে নিয়ে চলেছেন বৃন্দাবন থেকে মথুরার পথে। যেতে যেতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বড়াই তখন রাধাকে খুঁজতে খুঁজতে কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন। কৃষ্ণ রাধাকে আগে কখনোও দেখেনি। বড়াই তাই কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপ বর্ণনা করে। এবং রাধার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। বড়াই এর হাত দিয়ে তাম্বুল, ফুল ইত্যাদি উপহার স্বরূপ রাধার কাছে পাঠান। কৃষ্ণের এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে রাধা এবং বড়াই কে সরষে বলেন;-" নান্দের ঘরের গরু রাখোআল তা সমে কি মোর নেহা"

দান খণ্ডে দেখি কৃষ্ণ বড়াই এর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মথুরার পথে দানী সেজে বসেছে, বড়াই সখী পরিবৃতা রাধাকে ভুলিয়ে সেখানে উপস্থিত করল। কৃষ্ণ রাধা দধি দুগ্ধ সবই নষ্ট করে বলপূর্বক রাধাকে সম্ভোগ করলেন। এবং ছলে বলে কৌশলে রাধার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার অভীষ্ট পূরণ করে। ক্ষোভে অপমানে রাধা কৃষ্ণকে অপমান বা ভৎসনা করে  বলেন;-"এক ঠাই বাঢ়িলাহোঁ নান্দের ঘরে।/চন্ডাল কাহ্নাঞি এবে বল করে।।"

নৌকা খণ্ডে দেখি কৃষ্ণ আবার পারের কান্ডারি সেজে যমুনার ঘাটে রাধার সঙ্গে নৌকাডুবি চলে জলকেলি করছে। এখানে রাধার মধ্যে প্রতিকূল বাম্যভাব দূর হলো। এখানে দেখবার তাম্বুল, ফুল দান এবং নৌকা খণ্ডে রাধার মধ্যে যে প্রতিরোধশীল, সেই প্রতিরোধের তীব্রতা  প্রায় হ্রাস পেয়েছে।

ভার খন্ড এবং ছত্র খণ্ড এ দেখি রাধা কৃষ্ণকে একই রকম প্রস্তাব দিয়েছেন, যে- কৃষ্ণ যদি তার ও পষণার ভার বহন করে তাহলে তিনি কৃষ্ণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। কিন্তু পুথি এখানে খন্ডিত। ছত্র খণ্ডে একইভাবে কৃষ্ণ রৌদ্রের তীব তাপ থেকে রাধাকে রক্ষা করার জন্য ছত্র ধারণ করেছে, এক্ষেত্রে রাধা তাকে রতি দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এরপর কাহিনীর মানবিক আবেদন অগ্রসর হয়ে চলল। বৃন্দাবন খন্ডে দেখি কৃষ্ণ এক অনুপম উদ্যান তৈরি করেছে। সেই উদ্যানে কৃষ্ণ রাধাকে আহ্বান জানিয়েছে। লক্ষণীয় স্বামীর গৃহ থেকে রাধাকে কিভাবে বার করে নিয়ে আসতে হবে তার কৌশল কথা রাধা বলে দিয়েছ। এই খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসলো। এবং তাদের পরিপূর্ণ মিলন ও ঘটলো।

যমুনা খণ্ডে এসেছে পৌরাণিক প্রসঙ্গ। এই খন্ডের মধ্যে কৃষ্ণের কালিয়া দমন, গোপী গণের সঙ্গী জলবিহার, নারীদের বস্ত্রহরণ ইত্যাদি বিবৃত হয়েছে। রাধা অন্য গোপীগণদের  সঙ্গী কৃষ্ণের মেলামেশাকে অপছন্দ করে, এই ঈর্ষাই প্রেমের বড় প্রমাণ।

হার খণ্ডের মধ্যে কৃষ্ণ রাধার হার অপহরণ করলে তিনি কৃষ্ণের কু-চরিত্রের কথা মা যশোদা কে বলে দিলেন;-" বাঁরে বাঁরে কাহ্ন সে কাম করে।/ যে 

'কামে হ এ কুলের খাঁখাঁরে"।। কৃষ্ণ এতে রাধার  প্রতি রুষ্ট হয়ে রাধাকে মদন বান হানলেন বাণ খণ্ডে। এই বাণ খন্ডের মধ্যে রাধার চরিত্রের বেশ পরিবর্তন লক্ষিত হলো। এখানে রাধার দেহাশক্তি বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

বংশী খণ্ডে রাধা উত্তীর্ণ যৌবনা নারীতে পরিণত হয়েছে। কৃষ্ণের বংশী ধ্বনি  শুনে রাধার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বড়াইয়ের উপদেশে রাধা কৃষ্ণের বাসি চুরি করে নিলেন। কিন্তু পরে সে অবশ্য বাঁশি কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল রাধাকে।

সর্বশেষ অংশ হল রাধা বিরহ। এই অংশে রাধার নিদারুণ বিরহ দশা উপস্থিত হলো। 1 বিরহকাতরা রাধিকার নতুন রূপ আমরা দেখতে পাই। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় তাম্বুল খণ্ড থেকে বাণ খণ্ড পর্যন কৃষ্ণের্ত যে রূপের পরিচয় পেয়েছি সেখানে আর যাইহোক না কেন শোভনতা বা শালীনতা একান্ত অভাব আছে। পদাবলী সাহিত্যে আমরা যে রাধিকাকে পায় কৃষ্ণই তো তার সুখ সর্বস্বা, কৃষ্ণ অন্তপ্রাণ। রাধা প্রথম থেকেই তিল তুলসী দিয়ে কৃষ্ণের দেহ সমর্পণ করছেন। কিন্তু অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা প্রথম থেকেই প্রতিবাদী কৃষ্ণের আচরণের প্রতি, তৎসত্ত্বেও কৃষ্ণ তাকে প্রতিনিয়ত আহ্বান করেছে। এই আহ্বানে রাধা কোনরূপ সাড়া দেয়নি। সমস্ত প্রচলিত সামাজিক রুচি বা ধ্যান ধারণা দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় কৃষ্ণ প্রাথমিক ভাবে রাধার অভিষ্ট পূরণ করেছে। বিশেষ করে ভার খণ্ডে  বা ছত্র খণ্ডে, রাধার মনের পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। এখানেই একজন মানবী নারীকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি। যিনি প্রথম জীবনে বহু দুঃখ লাঞ্ছনা সহ্য করে যৌবনে পৌঁছেছে তবে তিনি কৃষ্ণ প্রেমের মহিমা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন।

রাধা বিরহ অংশে সেই সমগ্র নারীত্বের পূর্ণরূপ। এখানেও কৃষ্ণ তার অভিষ্ট পূরণ করেছে। কিন্তু রাধার মানবিক প্রেমকে কখনো মর্যাদা দেয়নি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবলই তার শারীরিক আকাঙ্ক্ষা নিবিত্ত করেছে। যে কৃষ্ণ নামে ভারতবর্ষে তথা ভারত সংস্কৃতি, গোটা বাংলাদেশ  নিমনা হয়ে পড়ে, শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে এই কৃষ্ণ সহ যোজন দূরত্ব। কিন্তু রাধা চরিত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। প্রাথমিকভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংযত হলেও শেষ পর্যন্ত রাধা কৃষ্ণের কাছে তার সর্বস্ব নিবেদন করেছে। সেই নিবেদনের মধ্যে কোথাও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা বহুবার কৃষ্ণের সঙ্গী সম্মিলিত হয়েও দেহজ বাসনা কামনা কে ভুলতে পারেনি। রাধার বাসনা বুঝি শেষ নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা যে মানবী। এটাই তার বড় প্রমাণ।

প্রমথনাথ বিশীর মতে;-" শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধার যেখানে শেষ, পদাবলীর রাধার সেখানে আরম্ভ"।

অমার্জিত রুচি, পরিপূর্ণভাবে গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট, অসংস্কৃত এই গ্রন্থে কৃষ্ণ চরিত্রের পাশে বড়ু চন্ডীদাস রাধা চরিত্রের যে অবকাশ সৃষ্টি করলেন তা অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে মানবিক। এখানেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধা চরিত্রের অভিনবত্ব।

Wednesday 28 March 2018

Srikrishnakirtan of Baru Chandidas / বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

বাংলা ভাষায় রচিত পদাবলী সাহিত্যের আদি কবি রূপে সিকৃতি লাভ করে বড়ু চন্ডীদাস। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক একখানি বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ তিনিই রচনা করেছিলেন। পুথিটি বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় ১৩১৬ সালে বন বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘর থেকে সংগ্রহ করেন। দেবেন্দ্রনাথ শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশজাত। পুথি মধ্যে গ্রন্থ রচনাকাল, গ্রন্থের নাম ও কবি পরিচিতি কিছুই পাওয়া যায়নি। পুথিটি তুলট কাগজে লেখা আগাগোড়া খণ্ডিত। এবং এর প্রথম এবং শেষের কয়েকটি পাতা নেই। বসন্তরঞ্জন বাবু কিংবদন্তি ও পূর্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করে এর নাম দেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামকরণের সার্থকতা

বড়ু চন্ডীদাসের কাব্য মধ্যে কোথাও গ্রন্থের নাম উল্লেখ দেখা যায়নি। গ্রন্থটি সম্পাদনকালে বসন্তরঞ্জন রায় নাম দেন'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। নামকরণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন;-" দীর্ঘকাল যাবৎ চন্ডীদাস বিরচিত 'কৃষ্ণকীর্তন' এর অস্তিত্ব মাত্র শুনিয়া আসিতেছিলাম। এতদিনে তাহার সমাধান হইয়া গেল। আমাদের ধারনা, আলোচ্য পুথিই' কৃষ্ণকীর্তন' এবং সেইহেতু উহার অনুরূপ নাম নির্দেশ করা হইল"। বসন্ত বাবুর এই নামকরণ এযাবৎকাল সকলেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির মধ্যে প্রাপ্ত একখানি রসিদ দেখে এই গ্রন্থটির নামকরণের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। পুথিটি আড়াইশো বছর আগে বন বিষ্ণুপুরের গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চানন নামক এক ব্যক্তি পুথিটির ষোলো খানি পত্র (৯৫-১১০ পত্র) গ্রন্থাগার থেকে ১০৮৯ সনের (১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দ) ২৬ শে আশ্বিন নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আবার তা ২১ শে অগ্রাহায়ণ ফেরত দিয়ে যান। গ্রন্থাগারের জনৈক কর্মচারী একটুকরো তুলট কাগজে তা লিখে রাখেন। এই চিরকুটে পুথির নাম (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ) উল্লেখিত আছে। কাজেই বসন্ত বাবুর নামকরণ যথার্থ হয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের ধারনা, গ্রন্থটির নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরিবর্তে 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' হলেই ঠিক হতো।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থটির আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন বাংলা ভাষার মূল্যবান নিদর্শন আমাদের হস্তগত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সমকালে যা কিছু পরে বিদ্যাপতির পদাবলী, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণবিজয় লেখা হলেও এদের প্রাচীন পুঁথি পাওয়া যায়নি। যে গ্রন্থ গুলির নাম বলেছি সেগুলির ভাষা ও নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক আধুনিক হয়ে গিয়েছে। সেকারণে, বাংলা ভাষার আদিরূপ চর্যার সঙ্গে এদের তফাৎ অনেকখানি বলেই মনে হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথি এই দুইয়ের মধ্যে মিলন সেতু রচনা করেছে। পরবর্তীকালের বৈষ্ণব ভাবাদর্শের সঙ্গী শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মিল না থাকলেও লোকসমাজে এর বিশেষ প্রচলন তেমন ছিল না। মোড়কে রক্ষিত ঔষধের মত এর ভাষা অপরিবর্তিতই থেকে গিয়েছে। ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথির ভাষা আলোচনা করে বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা ১৫শ শতকের পূর্ববর্তী বলে মনে করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর মধ্যে আহ্মি, তোহ্মি, মোক,বাএ, কাহ্ন ইত্যাদি বহু প্রাচীন শব্দ আছে যেগুলি এর প্রাচীনতাকে প্রমাণিত করে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির মত প্রাচীন ভাষা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে আর কোথাও পাওয়া যায় না।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয় বস্তু

রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা অনুসরণ করে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যখানি রচিত হয়। কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে মথুরাগমন, মথুরা হতে ক্ষণিকের জন্য প্রত্যাবর্তন মিলন রাধা কৃষ্ণের মিলন, তারপর কংস বধের জন্য কৃষ্ণের পুনরায় মথুরা গমন ও রাধার বিলাপ - এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে। তবে এই কাব্য তেরটি খন্ডে বিভক্ত হয়েছে। রাধা বিলাপের পর পুথিটি খন্ডিত হয়ে যাওয়ায় কাব্যটির শেষ পর্যন্ত বিরহে, না মিলনে শেষ হয়েছিল তা বোঝা যায় না। তবে প্রচলিত রীতি ও অলংকার শাস্ত্রের বিধান অনুসারে রাধাকৃষ্ণের মিলনের মধ্যে কাব্যটি শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই জন্য মনে হয় গ্রন্থ শেষে হয়তো রাধাকৃষ্ণের পূর্ণ মিলন বর্ণিত হয়েছিল। তবে কবি সর্বত্র যে অলংকার শাস্ত্রের নীতি মেনে চলেছেন এমন কথা বলা যায় না। মাঝে মাঝে তিনি আদি রসের এমন উৎকট প্রকাশ ঘটিয়েছেন যে তাতে রসাভাস সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আখ্যানভাগ মূলত তেরটি খন্ডে বর্ণিত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন খন্ড অনুসারে  আলোচনা করতে পারি-

(১) জন্ম খন্ড

এই জন্ম খন্ড রাধাকৃষ্ণের আর্বিভাবের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কংস নিধনের জন্য স্বয়ং বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে দৈবকীর উদরে জন্ম নিলেন এবং তাঁর সম্ভোগের জন্য বৈকুন্ঠের লক্ষী সাগরের ঘরে পদুমা উদরে রাধা রূপে জন্মগ্রহণ করলেন।

(২) তাম্বুল খণ্ড

তাম্বুল খণ্ডে এসে রাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক বেশ খসে পড়লো। রাধাকৃষ্ণের আচরণ প্রকৃত নরনারীর পর্যায়ে নেমে গেল। রাধা সব সখিগনের সঙ্গে মিলে বড়াই কে নিয়ে চলেছেন বৃন্দাবন থেকে মথুরার পথে। মাথায় দধি সরের পসরা। সখীদের সঙ্গে রস-পরিহাস করতে করতে বড়াই কে পিছনে ফেলে রাধা অনেকদূর এগিয়ে গেলেন। বড়াই তাকে খুঁজতে খুঁজতে অন্যপথে গিয়ে হাজির হল। পথমধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। বড়াই তার কাছে রাধার সন্ধান জিজ্ঞাসা করল। কৃষ্ণ তো রাধাকে চেনেনা তখন ঐ বড়াই রাধার রূপ বর্ণনা করতে লাগলো। তা শুনে কৃষ্ণের মনে রতি ভাব জেগে উঠলো। তিনি রাধা সঙ্গ লাভের জন্য আকুল হয়ে পড়লেন। একারণে রাধার সঙ্গে মিলনের জন্য কৃষ্ণ বড়াই কে অনুনয়-বিনয় করলেন। তারপর ফল তাম্বুল দিয়ে কৃষ্ণ বড়াই এর হাতে দিলেন। বড়াই কৃষ্ণের কথামতো রাধার কাছে ফল তাম্বুল নিয়ে উপস্থিত হলে, কৃষ্ণের সমস্ত কথা শুনে রাধা রুষ্ট হয়ে ফল তাম্বুল সহ লাথি মেরে ফেলে দিলেন। দেখা যায় এই খণ্ডে কৃষ্ণ তিন-তিনবার রাধার জন্য উপহার পাঠালেও বারবার রাধা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

(৩) দান খণ্ড

দান খন্ডে দেখা যায় কৃষ্ণ রাধার প্রতি ব্যভিচার করেছেন। এই খণ্ডে কৃষ্ণ তার মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য বড়াই কে সঙ্গে নিয়ে রাধাকে সম্ভোগ করলেন। কৃষ্ণের কথামত বড়াই রাধাকে ভুলিয়ে মথুরার পথে হাজির করল। সেখানেই কৃষ্ণ দানি সেজে সমস্ত দধি দুগ্ধ নষ্ট করে রাধাকে জোরপূর্বক সম্ভব করলেন।

(৪) নৌকা খন্ড

নৌকা খন্ডে দেখা যায় কৃষ্ণ পারের কান্ডারী সেজে যমুনার ঘাটে অপেক্ষা করে রইলেন এবং পার করার ছলে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে রাধার সঙ্গী জলকেলি তে মত্ত হলো। তবে এখানে রাধার প্রতিকূল বাম্যভাব দূর হলো।


(৫) ভার খন্ড

এই খণ্ডে দেখা যায় রাধা কৃষ্ণের সঙ্গী সঙ্গলাভে আকৃষ্ট। কৃষ্ণ, রাধার সমস্ত দধি দুধের পসরা মাথায় করে নিয়ে ভারী সেজে বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা করলেন।

(৬) ছত্র খণ্ড

এই খণ্ডে দেখা যায় রাধা কৃষ্ণের প্রতি একটু আসক্ত। কারণ রৌদ্রের তাপ-জ্বালা নিবারণার্থে রাধা  কৃষ্ণের মাথায় ছত্র ধরলেন। এবং রাধা তাকে রতি দানের আশ্বাস দিলেন।

(৭) বৃন্দাবন খন্ড

এই খন্ডে দেখা যায় রাধাকৃষ্ণের সম্পূর্ণ মিলন। রাধা যেমন আকুল কৃষ্ণের জন্য তেমনই কৃষ্ণ ও।

(৮) যমুনা খন্ড ও (৯) কালিয়া দমন খন্ড

যমুনা খন্ডের মধ্যে কৃষ্ণের কালিয়া দমন খণ্ডটি বিবৃত আছে। এছাড়াও এই খণ্ডে গোপীগণের সঙ্গে জলবিহার, গোপীগণের বস্ত্রহরণ বিবৃত হয়েছে।

(১০) হার খন্ড

এই খণ্ডে কৃষ্ণ রাধার হার চুরি করে নিলেন। ফলস্বরূপ রাধা যশোদা সমীপে কৃষ্ণের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন।

(১১) বাণ খণ্ড

হার খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের দুষ্কর্মের জন্য মা যশোদার কাছে নালিশ করলে কৃষ্ণ রাধার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ স্বরূপ রাধাকে মদন বাণে বিদ্ধ করলো।

(১২) বংশী খণ্ড

এই খণ্ডে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার মন বড় ই উতলা হল। বাঁশির সুরে রাধা শরীর আকুল, মন ব্যাকুল হয়ে গেল। বড়াই এর উপদেশে রাধা বংশী হরণ করে নিলেন। এরপর অনেক অনুনয় বিনয় করার পর রাধা কৃষ্ণের বাঁশি ফিরিয়ে দিলেন।

(১৩) রাধা বিরহ

রাধা বিরহ অংশে রাধার নিদারুণ বিরহ দশা উপস্থিত হল। বহু অন্বেষণের পর রাধা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন। ক্লান্তি ভরে তিনি কৃষ্ণের ক্রোড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। এই সুযোগে কৃষ্ণ ও রাধাকে ছেড়ে মথুরা গমন করলেন।

যাইহোক শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয়বস্তু একটু ভাল করে দেখলে বোঝা যায় কবি তার কাব্য মধ্যে রাধা ও কৃষ্ণ কে প্রকৃত মানব মানবীর আচার-আচরণ কেই তুলে ধরলেন। এখানে দেব মহিমা একেবারেই দ্বিখন্ডিত। বড়ু চন্ডীদাস প্রকৃত বাস্তব জীবনের নিখুঁত নর-নারীর জীবনচিত্রকে যেভাবে আঁকলেন তা মধ্যযুগের কোন কাব্যেই আমরা হয়তো পাবো না। তবে একটা কথা বলবার যোগ্য কবি যে সময়ে এই কাব্যটি রচনা করছেন সেই সময়ের সমাজবাস্তবতার, অর্থনৈতিক চেহারার, নর-নারীর আচার-আচরণ যেন  কৃষ্ণ ও রাধার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

Monday 26 March 2018

Language / Historical importance of Charyapada


 চর্যাপদের ভাষা:-

বাংলা ভাষার জন্মলগ্নে সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। বৌদ্ধ সাধকেরা চর্যার ভাষার মধ্য দিয়ে সাধনার গোপনীয়তা কে অনেকটা হেঁয়ালি ভঙ্গিতে ব্যক্ত করেছেন, তাই কোন কোন পন্ডিত এই ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষাতে অভিহিত করেছেন। চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশয়ের বক্তব্য;-" সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায় খানিক বুঝা যায় না"। এই ভাষা সন্ধ্যায় ম্লান গোধুলীলগ্নের মত এক গভীর রহস্য আছে- কতক স্পষ্ট কতক অস্পষ্ট। অর্থাৎ বাইরে এক অর্থ, ভিতর এক অন্য অর্থ; বাইরে সাধারন অর্থ, ভিতরে সুগভীর আধ্যাত্বিকতা। কোন কোন পণ্ডিতদের মতে সন্ধ্যা ভাষা না হয়ে'সন্ধা' ভাষা যার অর্থ অভিপ্রেত বা অধিপ্রায়িক রচনা। যে শব্দের অভিষ্ঠ অর্থ অনুধ্যান করে বুঝতে হয়। যাতে অদীক্ষিত বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা সহজিয়া সাধনার গূঢ় রহস্য বুঝতে না পারে এজন্য চর্যাপদকর্তাগণ সন্ধ্যা ভাষা ব্যবহার করেছেন। এই শব্দগুলি সাধন গত কতকগুলি রহস্যপূর্ণ ইঙ্গিত আছে, যা শুধু এই পথের পথিকরাই বুঝতে পারেন। সাধনার গোপনীয়তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পাড়া কতকগুলি কায়িক ও বাচনিক সংকেত সৃষ্টি করেছেন, এগুলির মাধ্যমে যোগীরা সম্প্রদায়ভুক্ত অন্য যোগীদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করতে বা তত্ত্বকথা আলোচনা করতেন। এই সংকেত এর তাৎপর্য কেবলমাত্র যোগীরাই বোধগম্য ছিল। সন্ধ্যা শব্দের কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোধগম্য হবে;- ('হরিনা' শব্দের বাহ্যিক অর্থ মৃগ/ হরিণ, কিন্তু এর সন্ধ্যা অর্থ  চিত্ত বা মন।)('করুণা' শব্দের বাহ্যিক অর্থ মৈত্রী, কিন্তু এর সন্ধ্যা অর্থ বোধিচিত্ত)।।


 চর্যাপদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব:-

সাহিত্য হল জীবনবেদ। মানব জীবনের বিচিত্র সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশার কাহিনী নিয়ে সাহিত্য গড়ে ওঠে। তাই কোন রচনার ঐতিহাসিক মূল্য আছে কিনা বিচার করতে গেলে দেখতে হবে তা জীবন কাহিনী আশ্রিত কিনা এবং ভাষা, ছন্দ ও অলংকারের সমন্বয়ে সেই রচনা চমৎকারিত্ব লাভ করে রস সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে কিনা। ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম মতবাদ ও দার্শনিকতা, সমাজ চিত্র, সাধন তত্ত্ব সাহিত্যে কাব্যমূল্যের দৃষ্টান্ত স্বরূপে চর্যাপদ ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করেছে।

প্রথমত, এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রাচীন যুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন।

দ্বিতীয়ত, চর্যাপদকে কেন্দ্র করেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্যিক ঐতিহ্যের অভিযান শুরু হয়েছে।

তৃতীয়ত, চর্যাপদের প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগ রাগিনী, তাল ও লয়ের উল্লেখ আছে। এ থেকে বোঝা যায় চর্যার পদগুলি গান হিসাবে গাওয়া হতো।

চতুর্থত, চর্যাপদের রূপক প্রতীকগুলির মধ্যে তৎকালীন সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।

পঞ্চমত, সংস্কৃত চিত্রাত্মক/ চিত্রধর্মী শ্লোকের বদলে বাংলা গীতি ধর্মী পদ রচনার সূচনা।

ষষ্ঠত, চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রবেশদ্বার স্বরূপ। এই গ্রন্থের ভাষা মাগধী অপভ্রংশ স্তর অতিক্রম করে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা রূপে সদ্য উদ্ভূত প্রত্ন বাংলাভাষার প্রামাণ্য উপকরণ।

সপ্তমত, বাংলা সাহিত্যেও চর্যার সুদূরপ্রসারী প্রত্যক্ষ প্রভাব ও তাৎপর্যপূর্ণ। চর্যার অনুবৃত্তি দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর নাথ সাহিত্য ও বাউল গানে।


 চর্যাপদ সাধন বিষয়ক রচনা হলেও মানব জীবনের সুখ-দুঃখের ভিত্তিতেই এর প্রতিষ্ঠা। গভীর মর্ত্য প্রীতি ও জীবন রস রসিকতা তাদের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রূপ ও অরূপ জগত চর্যাপদে একাকার হয়ে গেছে। এই কারণগুলির জন্য চর্যাপদ ঐতিহাসিক মূল্য লাভ করে।

Social life in Charyapada / Literary value of charyapada

চর্যাপদে বর্ণিত সমাজ জীবনঃ-

কোন যুগের সাহিত্যই সমাজ নিরপেক্ষ নয়। চর্যাগীতির রচয়িতা সিদ্ধাচার্যগণ ব্যক্তিগত সাধনা আর সহজানন্দ উপলব্ধিকে তার নিজস্ব শিল্পের রীতিতে প্রকাশ করেছেন। সাধনা প্রত্যয়ের দিক থেকে সমস্ত চর্যাগান এর বিষয়বস্তু একই ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুস্নার কথা। কিন্তু সেই সাধন প্রনালী প্রত্যেক সাধকের আপন অনুভূতির রসে বৈচিত্র‍্য মন্ডিত হয়ে উঠেছে। তৎকালীন সাধারণ বাঙালির প্রতিদিনের ধূলিধূসরিত জীবন চিত্র, সুখ দুঃখ, হাসি কান্নার টুকরো টুকরো রেখাচিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই সমস্ত পদগুলিতে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনীন্দ্র মোহন বসুর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য;- " যেহেতু কোন কবিই পারিপার্শ্বিকতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিতে পারে না, কখনও সচেতন, কখনও অচেতনভাবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব স্বীকার করিয়া বসেন। সেই জন্য চর্যার রচয়িতাগণ ও তাদের বাস্তব পরিমণ্ডলকে মাঝে মাঝে আভাসিত না করিয়া পারেন না।"

(১) ভৌগোলিক পরিবেশ:- 

চর্যাগীতি তে যে সমস্ত উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। চর্যাপদে খাল-বিল, নদী-নালা, বিশেষত নৌকা যাত্রার অতিরিক্ত উল্লেখ থাকায় নদীমাতৃক বাংলাদেশেরই কথায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন কবি লিখেছেন;-"ভবণ ই গহণ গম্ভীর বেঁগে বাহী।/ দু আন্তে চিখিল মাঁঝে ন থাহী।।"

(২) সমাজ বিন্যাস:- 

চর্যাগীতিতে চিত্রিত সমাজচিত্রের রুপটি প্রধানত হিন্দু সমাজের। সেই সমাজের উঁচু শ্রেনীতে ব্রাহ্মণ এবং নিম্ন শ্রেণীতে ডোম, চন্ডাল, শবরদের অবস্থান ছিল। প্রকৃতপক্ষে চর্যাপদে নিম্ন শ্রেণীর জীবন কথাই বর্ণিত হয়েছে। বর্ণাশ্রম প্রথা কঠোরভাবে বিদ্যমান ছিল। নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা সভ্য সমাজ থেকে দূরে বসবাস করত। তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাহ্নপাদের একটি পদে;-" নগর বাহিরে ডোম্বী তোহোরি কুড়িআ।/ছোই ছোই জাহসো ব্রাহ্ম নাড়িআ।।" ইত্যাদি পদে।

(৩)জীবিকা:- 

চর্যাগীতিতে যে ক'টি জীবিকা বা বৃত্তির ইঙ্গিত আছে, পা খুব একটা উচ্চমানের নয়। কায়িক পরিশ্রমই ছিল তাদের প্রধান সম্পদ। যেমন, কেউ কেউ ঝুড়ি,চাঙ্গড়ি, চুপড়ি ইত্যাদি তৈরি করত। এমন কি ডোম্বীরা খেয়া পারাপারের কাজ ও করত। শুধু তাই নয়, মাদুর বোনা, কাপড় বোনা, মাছ ধরা, মদ চোলাই করার কথা ও চর্যাগানে আছে। এমন কি হরিণ শিকার ও বাণিজ্য যাত্রার কথা ও জানা যায়। হরিণ শিকারের কাহিনীতে পুশু জীবনের অব্যক্ত মর্ম যন্ত্রণার ক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছে;- " আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।/খনহ ন ছাড় অ ভুসুকু অহেরী।।"

(৪) পারিবারিক জীবন যাপন:-

চর্যা যুগে পারিবারিক জীবন ছিল একান্নবর্তী শশুর, শাশুড়ি, ননদ, পুত্রবধূকে নিয়ে বিরাট সংসার। তবে সমাজের কোন কোন স্তরে ব্যভিচার ছিল।

(৫) আমোদ-প্রমোদ:- 

সেকালের মানুষেরা খেলাধুলার মাধ্যমে অবসর সময় কাটাতো। খেলাধুলার মধ্যে দাবা খেলা ছিল জনপ্রিয়;-"করুণা পিহাড়ি খেলহুঁ নববল"। এছাড়াও নাটক ও নৃত্য গীতের প্রতি বাঙালির বিশেষ একটা ঝোঁক ছিল। মেয়েরা নৃত্যগীতে খুব নিপুণা ছিল। চর্যাপদে বন্ধু নাটক ও অভিনয়ের কথা উল্লেখ আছে;-" বন্ধু নাটক বিসমা হোই"।। নগরের ধনী ব্যক্তিরা ছিল বিলাসী। তারা পালঙ্কে শুয়ে কপ্পুর মেশানো পান খেতেন। সে সময় মদ্যপানে রেওয়াজ ছিল খুবই জোরদার।

(৬) বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়:- 

চর্যার সময়ে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। তখনকার ব্রাহ্মণ,দন্ডী, জৈন, সন্ন্যাসী প্রভৃতিদের প্রতি চর্যাকারেরা কটাক্ষ করেছেন। সিদ্ধাচার্যের মাপে ব্রাহ্মণরা বেদের কিছুই  বোঝেনা। চর্যাপদের একটি পদে আছে;-"সু অল সমাহি অ কাহি করিঅই।/সুখদুখেঁতে নিচিত মরিঅই"।।

যাই হোক যুগান্তরে পরেও চর্যাপদের মধ্যে সদ্য মুকুলিত বাংলা ভাষায় অঙ্কিত সমাজ ও সংসার চিত্র অম্লান আছে। কবিগণ আধ্যাত্ম পথের যাত্রী হয়েও বিস্মৃত হতে পারেননি জীবনের মূল স্রোত থেকে। চর্যার বিষয়বস্তু বা লক্ষ্য আধ্যাত্মিক হলেও এর জীবনবোধের উৎস সম্পূর্ণরূপেই লৌকিক জগতের বিষয়।একারণেই চর্যাপদে সেই সময়কার বাস্তব সমাজ জীবনের ছবিকে দেখতে পায়।

চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য:-

সাহিত্যের অপর নাম জীবনবেদ। চর্যাপদ গুলির অবলম্বিত বিষয়, মোটেই সাহিত্যোচিত রস বস্তু নয়। বৌদ্ধ সহজিয়ারা তাদের সাধন তত্ত্ব প্রণালী এগুলি উপজীব্য। ধর্মকেন্দ্রিক রচনা হলেও চর্যাপদ গুলি হয়ে উঠেছে সাহিত্য সম্পদে সমৃদ্ধ। ধর্মীয় দার্শনিক তত্ত্ব কে কাব্যরূপ দেওয়ার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে উচ্চাঙ্গের কবি প্রতিভার নিদর্শন। চর্যাপদের কবিদের ছন্দ, শব্দ যোজনা এবং অলঙ্কারের ব্যবহার প্রশংসনীয়। শ্লেষ, অনুপ্রাস, উপমা-রূপক ইত্যাদি অলংকারের সার্থক প্রয়োগ চর্যাপদে শিল্প সমুজ্জ্বল রূপ পেয়েছে।

(১) অলংকার:-

সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাপদ শুধুমাত্র তত্ত্বই পরিবেশন করতে চেয়েছেন। সন্ধ্যা ভাষার আড়ালে তারা শব্দের লক্ষণা শক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন। এবং পদগুলিতে আমরা উপমা, বিপরীত ভাষণ ইত্যাদি অলংকারের সন্ধান পায়। যেমন;-"নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।/বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই।।" এখানে নাচন্তি ও গান্তি শব্দের সংযুক্ত ব্যঞ্জন 'ন্ত' ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়, এটি ছেকানুপ্রাসের উদাঃ।

(২) তাল এবং ছন্দ:-

চর্যাপদ গুলি গান এবং কবিতা আকারে সজ্জিত। প্রতিটি কবিতার শিরোনামে রাগের উল্লেখ আছে। বেশিরভাগ পদই রচিত হয়েছিল প্রত্নমাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তাতে রুদ্ধদল ও দীর্ঘস্বর দ্বিমাত্রিক। যেমন;-"কা আ ত রু ব র/প ঞ্চ বি ডা ল"(৮+৮)।।

(৩) চিত্র ধর্ম, সংগীত ধর্ম এবং গীতি প্রাণতা:-

হৃদয় উৎসারিত অনুভূতির প্রকাশ করতে গিয়ে নতুন নতুন চিত্র কল্পনা, সাধন প্রনালী ও রূপ রচনা করেছেন এই বৌদ্ধ মঠের সাধকেরা। এসকল চিত্ত কল্পনায় বর্ণনীয় বস্তুতে লাবণ্য ও সৌন্দর্য ব্যক্ত করে চর্যাপদকর্তাগণ অনন্য কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও প্রত্যেকটি পদে গীতি প্রাণতা লক্ষণীয়। যেমন;-"উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।/মোরঙ্গি পীচ্ছ পরিহণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।" মনীষী হার্ডসনের মতে;- " Personal or subjective poetry or the poetry self expressions or self delineation."

(৪) ছোট ছোট গল্প বা কাহিনী প্রসঙ্গ:-

চর্যাপদের বিভিন্ন পদে আমরা ছোট ছোট গল্প ও কাহিনীর প্রসঙ্গ খুঁজে পায়। সেগুলি আজকের গল্পের মত না হলেও মূলত কাহিনীর মূলসূত্র পাওয়া যায়। যেমন;-" টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী/ হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী

(৫) সাহিত্যরস:-

চর্যাপদ হল আধ্যাত্ম সংগীত। এজন্য শান্ত রস হল এর প্রধান রস। এছাড়াও করুণরস, হাস্যরস ও অদ্ভুত রসের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন;- "দুলি দুহিপিটা ধরণ ন জাই।/রুখের তেন্তুলি কুম্ভিরে খা অ।।"

(৬) প্রবাদ প্রবচন:-

বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য চর্যাপদকর্তাগণ কোন কোন বিষয় চর্যাপদের মধ্যে চিরন্তন যুক্তি ও প্রবাদ বাক্যের মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন;-" আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।" নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্য হরিণ নিজের শত্রু।

(৭) ধাঁধা প্রসঙ্গ:-

সন্ধ্যাভাষার আড়ালের মধ্যে দিয়ে চর্যাকারেরা চর্যাপদে ধাঁধার ব্যবহার করেছেন। যেগুলি আমাদের ধাঁধিয়ে দেয়। যেমন;-"জো সো বুধি সোই নিবুধী।/জো সে চোর সোই সাধী।।"

(৮) মিষ্টিক কবিতা:-

তত্ত্ববাদী সাধকেরা ছিলেন জীবন প্রেমিক কবি। তত্ত্ব প্রধান হলেও চর্যাপদের তত্ত্ব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এই জীবন চিত্রগুলি  লোকজগতের অভিজ্ঞতা, লোক চরিত্র চিত্র দক্ষতা নয়, জীবনরস রসিকতায় ভাষ্য। চর্যাপদ জ্ঞানের বিষয় নয়- ভাবের বিষয়, তত্ত্বের মৃণালে কাব্যের শতদল।



Context of Charyapada/ Writer of Charyapada প্রসঙ্গঃ চর্যাপদ

প্রসঙ্গঃ  চর্যাপদ

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন যা কিছু আবিস্কৃত হয়েছে তার সবই হল ধর্মভাবপুষ্ট পদ্য সাহিত্য। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, প্রাচীন যুগের সাহিত্য নিতান্ত ধর্মচেতনা ও গোষ্ঠীভাব সাধনাকে আশ্রয় করে সৃষ্ট হলেও উদ্দেশ্য প্রচারের প্রবণতাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ছাপিয়ে উঠেছে স্রষ্টার মধুরসিক্ত মননকল্পনা। একারনে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশনকে ও নিতান্ত প্রাচীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এইরকম বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন হল চর্যাপদ। এই চর্যাপদ কে নিয়ে দু একটা কথা আলোচনা করা হল -

রাত্রির অন্ধকার শেষ হলে দিনের আলো শুরু হয়। ভোরের প্রথম আলো যখন ফুটে ওঠে তখনও অন্ধকার জড়িয়ে থাকে। সেই আধ আলো আধ অন্ধকারে সবই কেমন অস্পষ্ট লাগে। এই ভোরের অস্পষ্টতায় পাখীরা জেগে ওঠে; তাদের কাকলী ছড়িয়ে দেয় আকাশে – বাতাসে। কিন্তু তাঁদের কলধ্বনির অর্থ সব বোঝা যায় না, কিন্তু তাঁদের আনন্দের অভিব্যাক্তি যে নতুন একটি দিনের শুরু হচ্ছে তারই আগমনী গান শোনা যায়। বাংলা সাহিত্য ও একদিন এমনি করে জন্ম নিয়েছিল। আর সেই জন্মলগ্নে পাখীর অস্পষ্ট কাকলীর মত বৌদ্ধ সাধন সঙ্গীত অপরিণত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল। ওই সময়ে দেশে তখন সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল। বর্তমান দিনে যেমন শিক্ষিত ওপরের মহলের ইংরেজি ভাষার প্রচলন আছে, সে যুগে ও অভিজাত কিংবা পদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল বেশী। সর্ব কাজেই সংস্কৃত ভাষা চলত, সাধারন মানুষ যদিও তার কিছুই বুঝতো না। সবই তাদের কাছে অন্ধকারের মতই অস্পষ্ট থেকে যেত। বাংলা ভাষার প্রথম নির্দশন ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ এই সন্ধিক্ষণে উষার আলোর মত জেগে উঠলো। চর্যাপদ আসলে বিভিন্ন পদকারদের রচিত সংকলন কোষগ্রন্থ। সদ্য জাত বাংলা ভাষাকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম সহজিয়া মঠের বৌদ্ধ সাধকগণ কয়েকটি গান রচনা করেন, যাঁরা এই ধর্মের নতুন দীক্ষা নিচ্ছেন তাঁদের কাছেই নিগূঢ় এই তত্ত্বটি প্রচার করাই ছিল এই রচনার মূল উদ্দেশ্য। এই গানগুলি চর্যাগীতি বা চর্যপদ নামে পরিচিত। এই চর্যাপদ সাধন-ভজন মূলক রচনা এতে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকগণের ধর্ম, তত্ত্বকথা, দর্শন, চিন্তা ও সাধন প্রণালী ব্যক্ত হয়েছে। চর্যাগীতিতে যোগীদের আচার ব্যবহারের নির্দেশ আছে বটে, কিন্তু সেই নির্দেশ আধ্যাত্মিক।

আবিষ্কার ও তত্ত্বপঞ্জী:-

চর্যাপদ শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, নবীন ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ হিসাবে ও বিবেচিত। ডঃ প্রয়াত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সর্বপ্রথম এই গ্রথের আবিষ্কর্তা। এশিয়াটিক সোসাইটির মেম্বার হিসাবে শাস্ত্রী মহাশয় তিনবার নেপালে যান, পুথি সংগ্রহের জন্য। শেষ একবার নেপালে যাল ১৯০৭ খ্রীঃ। তিনি নেপালের রাজদরবার থেকে তালপাতার লেখা কতকগুলি পুথির সন্ধান পান এবং সেগুলিকে “ হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নাম দিয়ে ১৯১৬ খ্রীঃ বাংলায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে প্রকাশ করেন। এতে মোট চারটি খণ্ড ছিল -  চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরোজব্রজের দোহা, কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও ডাকার্ণব। শাস্ত্রী মহাশয় সব কটাই বাংলা ভাষায় লেখা হিসাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু পরবর্তিকালে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ ভাষাতাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র প্রথম পুথি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের ভাষাই বাংলা।

চর্যাপদের কবিগণ

আমরা আগের টপিকে আলোচনা করেছিলাম বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ কে নিয়ে। এবং সেই সাথে আমরা চর্যাপদের আবিষ্কার তথ্যপঞ্জি নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছি। এবার আমরা চর্যাপদ এর বিষয়বস্তু ও কবি পরিচিতি সম্বন্ধে জেনে নেব। চর্যাপদের বিষয়বস্তু হল সহজিয়া দর্শন ও সাধন তত্ত্ব। পদকর্তাগণ সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। অশ্রদ্ধাশীল সাধারণ মানুষ যাতে সাধনার গূঢ়তত্ত্ব অবগত হতে না পারে সেজন্য সিদ্ধাচার্যগণ তাদেরগুহ্য সাধনতত্ত্বকে প্রকাশ করতে গিয়ে দুরূহ দুর্বোধ্য রূপক-সাংকেতিক, প্রহেলিকাময় ভাষার ব্যবহার করেছেন। অনূন্য ২৩ জন পদকর্তার রচিত পদ পাওয়া গিয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কবিদের ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে জেনে নেব।


(১) লুইপা:-

লুইপা একজন বাঙালি কবি। তেঙ্গুরে বাঙালি বলেই লুইয়ের নাম উল্লেখ আছে। অধ্যাপক নির্মল দাশের অভিমত;- " চর্যাগীতি সংগ্রহের প্রথম কবি লুই। শুধু পদসংখ্যার ক্রমানুসারেই, তিব্বতি ঐতিহ্যে যে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায় লুই তাঁদের মধ্যে ও অন্যতম"। মহা মনিষী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সাথে তার পরিচয় ছিল। শ্রীজ্ঞান ১০৩৮ সালে বিক্রমশীল বিহার হতে তিব্বত যাত্রা করেছিলেন। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে দশম শতকের শেষ ভাগে অথবা একাদশ শতকের প্রথম ভাগে লুইপাদের সহজ তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল। চর্যাপদে লুই প্রণীত দুটি পদ (১,২৯) সংকলিত হয়েছে।

(২) কাহ্ন পা বা কৃষ্ণাচার্য:-

'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে'কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের তেরটি পদ সংগৃহীত হয়েছে। তারমধ্যে বারটি পদ শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে এবং অপর দুটি প্রবোধ বাগচী সম্পাদিত তিব্বতীয় অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। পদরচনায় কাহ্নপাদ বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে,কাহ্নপাদ সবমিলিয়ে ৫৭ টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিব্বতীয় ৮৪ জন মহাসিদ্ধার নামের তালিকায় কানহ্ পাদ বা কনপ সপ্তদশ স্থানীয়। ৩৬ সংখ্যক চর্যাপদে কাহ্নপাদ নিজেকে জালন্ধরী পাদের শিষ্য বলে পরিচয় দিয়েছেন।

(৩) শান্তিপাদ:-

'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' এ শান্তিপাদের ভনিতায় দুটি পদ(১৫,২৬) পাওয়া যায়। কিন্তু কবির আসল নাম জানা যায়নি। এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯০ সংখ্যক পুথির বিবরণে জানা যায় শান্তিদেব রাজার ছেলে ছিলেন। সংসার ত্যাগ করে তিনি প্রথমে মঞ্জুব্রজের শিষ্যত্ব  গ্রহণ করেছিলেন। শেষ জীবনে কবি বৌদ্ধ ভিক্ষু রূপে নালন্দায় বসবাস করেন। সেখানে তিনি সর্বদা শান্তি থাকেন বলে তাকে শান্তিদেব বলেঅভিহিত করা হতো।

(৪) ভুসুকু পা:-

"আশ্চর্যচর্যাচয়" গ্রন্থের ২৩ জন কবির মধ্যে একজন অন্যতম কবি ভুসুকু। জানা যায় ধর্মপালের রাজত্বকালে কবি বর্তমান ছিলেন। তাঁর জীবিতকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ। কবির জন্মস্থান নালন্দা। ইনি ছিলেন একজন অশ্বারোহী সৈনিক। পরবর্তীকালে তিনি ভিক্ষু এবং সিদ্ধ হন। রাজপুত্র রূপে কবির প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি চর্যাপদের আটটি পদ রচনা করেছেন। তবে কবি ভুসুকু এবং শান্তিদেব যে একই ব্যক্তি এনিয়ে সংশয় আছে।

(৫) সরহ পা:-

'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' সরহপাদের চারটি পদ সংকলিত হয়েছে। কবির সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিব্বতীয় ৮৪ জন মহাসিদ্ধার তালিকায় সরহপাদের অপর নাম রাহুল ভদ্র। তবে কোন কোন পণ্ডিতের মতে, চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সরহ ভনিতার পদগুলি এক বা একাধিক সরহের রচনা বলে মনে করেন।

(৬)শবরপাদ:-

চর্যাকার শবরপাদের দুটি পদ 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' সংগৃহীত হয়েছে। কবির নামে নানা স্থানে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আবার কারো কারো মতে শবরপাদ বাংলাদেশের কোনোও পাহাড়ি জাতি বিশেষ শবর হিসাবে অভিহিত করেছেন। নাগার্জুনপাদ তাকে বজ্রযান ধর্মে দীক্ষিত করেন। কিন্তু রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের মতে শবরপাদ সরহের শিষ্য এবং লুইপাদের গুরু। শবরপাদ বজ্রযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থাবলীর  মধ্যে "বজ্রযোগিনী সাধনা", "মহামুদ্রাবজ্রগীতি" প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও চর্যাপদে আরো অন্যান্য পদকর্তা আছেন,যাঁদের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। আমরা সমস্ত পদকর্তার কথা উল্লেখ করতে পারেনি তবে বিশেষ কয়েকজন কবির কথা আমরা উপরিউক্ত ভাগে আলোচনা করেছি। সমস্ত viewers কিংবা ছাত্র ছাত্রী যদি চর্যাপদের আরো অন্যান্য কবির কথা কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় জানতে চাও তাহলে আমাকে comment করে লিখে পাঠিও। ধন্যবাদ।।

History of Buddhism / Described theoretical theory of Charyapada

বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস


বৌদ্ধ ধর্ম মোটামুটিভাবে দু'ভাগে বিভক্ত- হীনযান বৌদ্ধ ধর্ম ও মহাজান বৌদ্ধ ধর্ম। বুদ্ধদেব নিজে কোন রূপ ধর্মগ্রন্থ রচনা করে যাননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উপদেশাবলী সংগ্রহ করার জন্য প্রথমত রাজগৃহ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রায় এক বছর পর বৈশালীতে দ্বিতীয় সভার অধিবেশন হয়। এরপরে মহারাজ অশোকের আমলে পাটালিপুত্রে তৃতীয় সভা এবং মহারাজ কনিষ্কের রাজত্বকালে চতুর্থ সভার অধিবেশন হয়েছিল। এইসকল ধর্মসভায় বুদ্ধদেবের উপদেশ অবলম্বন করে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম নামক তিন পিটক বা পেটিকা নামক সংগ্রহ গ্রন্থই প্রধান। এই সকল গ্রন্থই পালি ভাষায় রচিত। গ্রন্থ গুলির সন্ধান সিংহল, ব্রহ্ম, ও শ্যাম প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের দর্শনের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাকেই প্রাচীন মতেই নাম হল হীনযান। এরপর খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের দিকে মহাযান- সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান ঘটে। নাগার্জুন, অসঙ্গ, বসুবন্ধু প্রভৃতির আচার্যগণ প্রাচীন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে সংস্কৃত ভাষায় তাদের মতামত প্রচার করেছেন। এই হল মহাযান মত। তিব্বত, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে এই মত বিস্তৃতি লাভ করে।


হীনযান ও মহাযান:

হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায় মধ্যে বিরোধ চরম আদর্শ, উপদেশ, উপদেশের প্রয়োগ, সাধনার আলম্বন ও সাধন কালের পরিমাণ নিয়ে। এসকল বিষয়ে প্রাচীনেরা হীন ছিলেন বলেই তারা হীনযানী। প্রাচীন স্থবির বাদী বা থেরবাদীদের চরম আদর্শ ছিল- শূন্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে নির্বাণ অবলম্বন করে অর্হত্ত লাভ করা। কিন্তু মহাযানীদের উদ্দেশ্য ছিল আরোও উদার। তাঁরা বললেন;-" নির্বাণ লাভ করে 'অর্হৎ' হলে চলবে না; দুঃখ প্রপীড়িত বিশ্ব জীবের মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আত্ম মুক্তির ত্যাগ করতে হবে, নির্বাণ লাভের উপযুক্ত হলেও নির্বাণ ত্যাগ করে শূন্যতায় প্রতিষ্ঠিত থেকেই মহা করুণা অবলম্বনে বিশ্ব জীবের মুক্তির জন্য অনন্তকাল ধরে কুশল কর্ম করে যেতে হবে এটাই হল মহাযানীর পথ"।।

বজ্রযান ও সহজযান:

বিভিন্ন ধরনের ধর্মবিশ্বাস ও প্রচলিত সাধন পদ্ধতি ক্রম প্রবেশের ফলে মহাযান মত পরিবর্তিত ও বিশ্লিষ্ট হয় দেখা দিল দুটি মত- 'পারমিতানয়' ও 'মন্ত্রনয়'।'পারমিতানয়'  পরিকল্পিত মহাযানের বিশুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্ব আশ্রয় করে। আর 'পারমিতানয়'এ অনুশীলনের উপরে গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের মন্ত্রের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে সৃষ্ট  হল 'মন্ত্রনয়'। আবার এই 'মন্ত্রনয়' এর সঙ্গে নানা প্রকার দেবদেবীর পূজার্চনা, ধ্যান-ধারণা, তান্ত্রিক ক্রিয়া বিধি,গুহ্য যোগ সাধনা ইত্যাদি প্রযুক্ত হয় বজ্রযান উদ্ভূত হল। 'বজ্র' শব্দের বৌদ্ধ তান্ত্রিক অর্থ শূন্যতা, বজ্রযান তাই শূন্যতা-যান। আর অন্যদিকে বজ্রযান পন্থী একদল সাধকের কতকগুলি বিশিষ্ট মত ও সাধন পদ্ধতি অনুসরণ করে পরবর্তীকালে সহজযান নামক এক বিশেষ  সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এদের সাধ্য ও সহজ, সাধন ও সহজ; তাই এরা সহজিয়া সাধক রূপে খ্যাত. সহজ শব্দে অর্থ হল সহ-জাত। যে ধর্ম প্রত্যেক জীব বা বস্তুর জন্ম থেকেই উৎপন্ন তারাই বিরাজ করে। সহজিয়াগণের মূল আদর্শ এই সহজ রূপকে উপলব্ধি করে মহাসুখে মগ্ন হওয়া। এছাড়াও সহজিগণ কখনো ও সাধনার জন্য বক্রতা অবলম্বন করতেন না- সহজ সরল পথই তাঁদের সাধন জীবনের একমাত্র অবলম্বন।

চর্যাপদে বর্ণিত সাধন তত্ত্ব:

বৌদ্ধ সহজিয়াগণের সাধনা মূলত তান্ত্রিক সাধনা। তন্ত্র সাধনা হল দেহ-সাধনা- দেহকে যন্ত্র করে তার ভেতরেই পরম সত্যকে উপলব্ধি করার সাধনা। তান্ত্রিকদের মতে দেবো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র রূপ- ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যা কিছু সত্য নিহিত আছে তা এই দেহভান্ডের মধ্যে ও রয়েছে। সহজিয়াগণ বলেন, দেহের মধ্যে অবস্থান করছে যে সহজ স্বরূপ তাই হল বুদ্ধ -স্বরূপ। চর্যাপদ গুলির মধ্যে এই তন্ত্র সাধনা তথা দেহ সাধনার কথা বহুস্থলে উল্লিখিত হয়েছে। পদকর্তাগণ বারবার বলেছেন-"নিঅড়ি বোহি মা জাহুরে লাঙ্ক"। অর্থাৎ এই দেহেই আছে বোধি তাকে লাভ করার জন্য লঙ্কায় যাবার প্রয়োজন নেই। সহজিয়য়াগণ দেহের মধ্যে চারটি চক্র বা পদ্ম কল্পনা করেছেন। প্রথম চক্র অবস্থিত নাভিতে, যাকে বলা হয় 'নির্মাণ চক্র'। দ্বিতীয় চক্র হৃদয়ে, যাকে বলা হয় 'ধর্মচক্র'। তৃতীয় চক্র কন্ঠে, যাকে বলা হয় 'সম্ভোগ চক্র'। এবং চতুর্থ চক্রের অবস্থান মস্তকে, যাকে বলা হয় 'সহজচক্র বা মহাসুখচক্র'। যোগসাধনার দিক থেকে দেখা যায় এই দেহের মধ্যে তিনটি প্রধান নাড়ী আছে। একটি 'বামগা', প্রাণবাহী শ্বাসবাহী নাড়ী( হিন্দু তন্ত্র মতে -ইড়া ) বলা হয়। অপরটি 'দক্ষিণগা',প্রশ্বাসবাহী নাড়ী(হিন্দু তন্ত্র মতে- পিঙ্গলা) বলা হয়। এবং আরেকটি নাড়ী আছে তার নাম হলো 'মধ্যগা'নাড়ী, যাকে (বৌদ্ধ তন্ত্র মতে অবধূতিকা বা হিন্দু তন্ত্র মতে -সুষুম্না বলা হয়)। সাধনার ক্ষেত্রে বামগা- দক্ষিণগা এই নাড়ী দুটিকে শূন্যতা- করুণা, প্রজ্ঞা -উপায়, নিবৃত্তি-প্রবৃত্তি, গ্রাহক- গ্রাহ্য, আলি- কালী, দিবা-রাত্রি, চন্দ্র-সূর্য, ভব- নির্মাণ ইত্যাদি অনেক নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই নাড়ী দুটি দ্বৈত তত্ত্বের প্রতীক। তৃতীয় নাড়ীটি( অবধূতি বা অবধূতিকা)অদ্বয় বোধিচিত্ত বা সহজানন্দ লাভের জন্য মধ্য মার্গের প্রতিক। চার্যার বহু স্থানে নানাভাবে এই মধ্যপথে কথা বলা হয়েছে। কারণ বৌদ্ধ সহজিয়াগণের আসল সাধনা হল- সর্ব প্রকারের দ্বৈতবিবর্জিত হয়ে অদ্বয় মহাসুখে বা সহজরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকা। তন্ত্র সাধন মতে প্রথমে বামা ও দক্ষিণা নাড়ী দুটিকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে হবে।এদের "ক্রিয়াধারা স্বাভাবিক ভাবে নিম্নগা; এই নিম্নগা ধারাকে যোগের সাহায্যে প্রথমে বিশুদ্ধ করিয়া রুদ্ধ করিতে হইবে- তাহার পরে সমস্ত ধারাকে একীকরণের সাধনা; যখন সব ধারা একীকৃত হইল মধ্যমার্গে- তখন সেই মধ্যমার্গে তাহাকে করিতে হইবে উর্দ্ধগা। সেই উর্দ্ধগা ধারায় আনন্দধারা, সেই আনন্দের মধ্যে অনুভূতি তারতম্য আছে; প্রথমে যে উর্ধ স্পন্দনাত্মক আনন্দনাভূতি তাহার নাম আনন্দ,- দ্বিতীয়ানুভূতি হইল পরমানন্দ- তৃতীয়ানুভূতি বিরামানন্দ- চতুর্থানুভূতি হইল সহজানন্দ। এই চতুর্থানুভূতি সহজানন্দই  হইল চতুর্থশূন্য- প্রকৃতি  প্রভাস্বর সর্বশূন্য।  বোধিচিত্ত  উষ্ণীষ কমলস্থিত চন্দ্র,- সহজানন্দেই ঘটে সেই চন্দ্র হইতে অমৃত ক্ষরণ"।। (ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত)




Literature / Literature written before the development of language

   সাহিত্য


“সাহিত্য” শব্দের  মধ্যে রয়েছে “সহিত” কথাটি । “সহিত” শব্দটি থেকে সাহিত্যের উৎপত্তি। অর্থাৎ ধাতুগত অর্থ ধরলে সাহিত্য শব্দের মধ্যে একটি মিলনের ভাব দেখতে পাওয়া যায়, সে যে কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়-ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তা নয়, -“ মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানে, দূরের সহিত নিকটে, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগসাধন। সাহিত্য ব্যাতিত আর কিছু তারই সম্ভব নহে”। বস্তুত; “বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারন করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্র এবং সেই গানই সাহিত্য”।। ( সাহিত্যের তাৎপর্য ) সুতারাং , “নিজের কথা, অপরের কথা, বিশ্বজগতের কথা, সাহিত্যিকের মনোবীনায় যে সুরের ঝংকার তোলে তাঁর শিল্পসম্মত প্রকাশের নাম সাহিত্য”।।

* নিজের কথা বলতে কবি নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি ভালোলাগা ও ভালোবাসা।।

* অপরের কথা বলতে কবির নিজের কথা নয়, অপরের কথায় পরিবেশিত করেছে  তার জারক রসে জারিত করে।।

* বিশ্বজগতের কথা বলতে কবি এখানে বাইরের ভূখণ্ডের আশেপাশের অবস্থার কথা বলেছে।।

* সাহিত্যর মনোবীনায় যে সুরের ঝংকার তোলে বলতে কোনো বিষয় সাহিত্যিকের অন্তরের অনুভূতি স্পর্শ পেয়ে যে রস রূপ নির্মাণ করে তোলে তারই কথা।

                           

সাহিত্যের কাজ

‘সাহিত্যের বিচারক’  প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,- “অন্তরের জিনিসকে বাহিরের ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ”। 



সাহিত্যর প্রকাশ

সাহিত্য জিনিসটাই শিল্পসম্মত একটা ব্যাপার। মনের ভাবকে সাহিত্যিকরা বিচিত্র বর্ণের , বিচিত্র রূপের, বিচিত্র ছন্দে প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে এ প্রসঙ্গে আসে প্রকাশের বাহন সেটা হল অর্থ যুক্ত শব্দ। সাহিত্যের যে শব্দ গুলো হওয়া প্রয়োজন তা হল অলংকার। এবং তার অর্থ যুক্ত শব্দে থাকবে ব্যাঞ্জনা । তবেই এটাই হল সাহিত্য।



Saturday 24 March 2018

Turkish Invasion Of Bengal & Its Consequence / বাংলায় তুর্কী আক্রমণ ও তার ফলশ্রুতি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। এর রচনাকাল খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। চর্যাপদের পর প্রায় আড়াইশো বছর বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। আর এই বাংলা সাহিত্যের বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ হিসাবে তুর্কী আক্রমণকেই দায়ী করা হয়। এই তুর্কী আক্রমণ বাংলায় কোন আকস্মিক ঘটনা বা ভাগ্যের পরিহাস নয়- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনিবার্য পরিণাম। দ্বাদশ শতাব্দী শেষার্ধে তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজী বিহার ও বাংলাদেশ বিজয়ের জন্য অভিযান শুরু করেন এবং ত্রয়োদশ শতকের একেবারে প্রথমে বাংলাদেশের সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তুর্কীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলপূর্বক অপরকে ধর্মান্তরিত করা, অপরের সংস্কৃতিকে বিধ্বস্ত করা। তারা ছিল ধর্মোন্মাদ, যুদ্ধবাজ ও সাহসী। তারা হিন্দু দেবদেবীর মঠ, মন্দির, শিক্ষায়তন, দেবমূর্তি প্রভৃতি ধ্বংস করে মসজিদ ও মুসলিম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয় নর-নারী নির্যাতন, হত্যা, গৃহদাহ প্রভৃতির মাধ্যমে তুর্কীরা ভয়াবহ তুর্কী নাচন শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন;-" বখতিয়ারের নবদ্দীপ জয় এবং একশত বৎসর মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়িয়া মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়, ভাগ্যের পরিহাস ও নয়-  রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনির্বায পরিণাম"।।

তুর্কী বিজয়ের ফলশ্রুতি: সামাজিক পরিণাম:-

তুর্কী আক্রমণের প্রচণ্ড আঘাতে বাঙালির জীবন নানাদিক থেকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে একথা ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সমাজ জীবনে এর সুফল ফলতে থাকে।

(ক) সামাজিক ভেদাভেদ:-

সেন রাজবংশের সময় দেশে কৌলিন্য প্রথা, বর্ণভেদ, জাতিভেদ, খুব কঠোর ভাবে বিদ্যমান ছিল। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য,  প্রায়শ্চিত্ত ও সংস্কার সেন যুগেই ব্যাপকভাবে প্রসারতা লাভ করে। বাঙালি সমাজে শ্রেণীবিভাগ থাকায় তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দের সঙ্গে নিম্ন শ্রেণীরদের কোন হৃদয়ের সংযোগ ছিল না। ফলে নিম্নবর্গের লোকেরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ইসলামের নব্য মানবতার পরিচয় পেয়ে এই ধর্মের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।

(খ) হিন্দু সমাজের সুস্পষ্ট বিভেদ:-

শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষেরা সে যুগের কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। এদের আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বণ, সংস্কৃতির সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীর আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বণ বা সংস্কৃতির কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলনা। ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভেদ নীতি গড়ে উঠেছিল।

(গ) অখন্ড বাঙালি জাতি:-

তুর্কী বিজয়ের ফলে বিজয়ী রাজশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে অভিজাতরা সব বিভেদ, বিচ্ছেদ অবজ্ঞাকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষার কাজে এগিয়ে গেলেন। রাষ্ট্রিক ঘূর্ণিঝড়ে আলোড়িত বাঙালি জাতি আর্য অনার্য, উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একত্রে মিলিত হয়ে এক অখণ্ড বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার সুযোগ পেল। ডঃ সুকুমার সেনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন;-" আর্য- অনার্যের মধ্যে সংস্কৃতিগত ধর্মবিশ্বাসগত আচার-ব্যবহারগত ও ভাবধারাগত এইযে স্তরভেদ ইহা বিলুপ্ত হইয়া অখন্ড বাঙালি জাতি গঠিত হইয়া উঠিবার পক্ষে একটি প্রধান বস্তুর অভাব ছিল, দ্বিতীয় পক্ষের সংঘাত"।

(ঘ) হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি:-

তুর্কী আক্রমণের ফলে কেবল উচ্চ-নিম্ন বর্ণভেদ তৈরি হয়েছিল তা নয়, হিন্দু মুসলিমদের মিলন ও সাধিত হয়েছিল। দুটি স্বাতন্ত্র সভ্যতা পরস্পরের সংস্পর্শে এসে পরস্পরকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে। এবং স্বাভাবিকভাবে বাঙালি জীবনযাত্রা নানাভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, ভাষা সংস্কৃতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ-বর্জন নীতিতে নতুনত্ব প্রকাশিত হতে শুরু করল।

(ঙ) বাঙালি সমাজে অর্থনীতি প্রাধান্য:-

তুর্কী বিজয়ের পরে ভারতীয় জনজীবনের সঙ্গে যোগসূত্রে বাংলার কৃষিজ, শিল্পজাত সম্পদ বাঙলার বাইরে বিক্রিত হয়ে অর্থনীতিতে নতুন দিকের সূচনা করলো। কৃষিজীবী থেকে বহির্বাণিজ্য এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যা বাংলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম ধীরে ধীরে নগরে পরিণত হল।

(চ) হিন্দুত্ব বোধ সৃষ্টি:-

তুর্কী বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতিরূপে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম হিন্দুত্ব বোধ জাগ্রত হল। তুর্কী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায়"হিন্দু" নাম সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতির পরিচয়, উপাধি, বাংলা স্থানের নাম প্রভৃতি বিষয়ে তুর্কী বিজয়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তুর্কী বিজয়ের ফলশ্রুতি: সাহিত্যের প্রভাব:-

(ক) মঙ্গলকাব্যের শাখা:-

তুর্কী বিজয়ের বহুমুখী প্রভাবের অন্যতম হলো সাহিত্যের নতুন চেতনার প্রকাশ। তুর্কী শাসনকালে অর্থাৎ অন্ধকার যুগে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ বিপদ থেকে ত্রাণের জন্য মনষা-চণ্ডী ইত্যাদি দেবদেবীর কল্পনা করেছেন। পরবর্তীকালে এই সমস্ত লোকায়তিক দেবতা ক্রমশ উন্নততর হয়ে মঙ্গলকাব্যের দেবতারূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো। রাষ্ট্রীয় অভিঘাতের আকস্মিক দিক প্রকাশ অনন্যপায় উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের অনেক অনার্য দেবদেবীকে স্বীকার করে নিল। উচ্চ-নিম্ন বর্ণের এই সহজ যোগাযোগের ফলে মঙ্গলকাব্য নামক কাব্য ধারাটি শিল্পসম্মত রুপ পেয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক আশ্চর্য সংযোজন রূপে প্রকাশ হলো।

(খ) অনুবাদ সাহিত্য শাখা:-

এই নবগঠিত বাঙালি জাতির সামনে সর্বভারতীয় পৌরাণিক হিন্দুত্বের একটি আদর্শকে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভূতি হয়েছিল; রামায়ণ,  মহাভারত ও ভাগবতের কাহিনী অনুবাদের বাসনা এমনইভাবে জন্ম নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ডঃ দীনেশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন;-" মুসলমান, ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন"। অন্ধকার পর্বের অর্থাৎ ( ১২০১-১৪০০ ) প্রায় দুশো বছরে যেমন মঙ্গল দেব দেবীর পূজার্চ্চনার বিস্তার ঘটিয়েছে, তেমনি অপৌরাণিক জনসংস্কৃতির মর্জ্জায় রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে পুরাণ কাহিনীর রস প্রবেশ করেছে। পৌরাণিক হিন্দুধর্মের আদর্শ সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে এই তথ্যগুলি অনুবাদের প্রয়োজন দেখা দিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সূচনায় ছিল ধর্মীয় সংস্কৃতিক ও প্রতিরোধের সাহিত্য। বলা যেতে পারে নব্য গঠিত বাঙালি জাতি বিশিষ্ট রূপে আত্মপ্রকাশের সাহিত্য।

সুতরাং এইভাবেই তুর্কী আক্রমণের ফলেই বাংলা সমাজে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মিলন হয়েছিল তেমনি হিন্দু-মুসলিম জাতির সমন্বয় ও ও সাধিত হয়েছে একান্ত সহজভাবে। শুধু তাই নয়, এরই ফল স্বরূপে সাংস্কৃতিক জীবনের বিস্তৃত বিকাশ ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে। নতুন ভাবে জেগেছে সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা। তাই ঐতিহাসিক দিক থেকে তুর্কী আক্রমণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।।

Popular