Wednesday 28 March 2018

Srikrishnakirtan of Baru Chandidas / বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

বাংলা ভাষায় রচিত পদাবলী সাহিত্যের আদি কবি রূপে সিকৃতি লাভ করে বড়ু চন্ডীদাস। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক একখানি বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ তিনিই রচনা করেছিলেন। পুথিটি বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় ১৩১৬ সালে বন বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘর থেকে সংগ্রহ করেন। দেবেন্দ্রনাথ শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশজাত। পুথি মধ্যে গ্রন্থ রচনাকাল, গ্রন্থের নাম ও কবি পরিচিতি কিছুই পাওয়া যায়নি। পুথিটি তুলট কাগজে লেখা আগাগোড়া খণ্ডিত। এবং এর প্রথম এবং শেষের কয়েকটি পাতা নেই। বসন্তরঞ্জন বাবু কিংবদন্তি ও পূর্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করে এর নাম দেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামকরণের সার্থকতা

বড়ু চন্ডীদাসের কাব্য মধ্যে কোথাও গ্রন্থের নাম উল্লেখ দেখা যায়নি। গ্রন্থটি সম্পাদনকালে বসন্তরঞ্জন রায় নাম দেন'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। নামকরণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন;-" দীর্ঘকাল যাবৎ চন্ডীদাস বিরচিত 'কৃষ্ণকীর্তন' এর অস্তিত্ব মাত্র শুনিয়া আসিতেছিলাম। এতদিনে তাহার সমাধান হইয়া গেল। আমাদের ধারনা, আলোচ্য পুথিই' কৃষ্ণকীর্তন' এবং সেইহেতু উহার অনুরূপ নাম নির্দেশ করা হইল"। বসন্ত বাবুর এই নামকরণ এযাবৎকাল সকলেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির মধ্যে প্রাপ্ত একখানি রসিদ দেখে এই গ্রন্থটির নামকরণের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। পুথিটি আড়াইশো বছর আগে বন বিষ্ণুপুরের গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চানন নামক এক ব্যক্তি পুথিটির ষোলো খানি পত্র (৯৫-১১০ পত্র) গ্রন্থাগার থেকে ১০৮৯ সনের (১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দ) ২৬ শে আশ্বিন নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আবার তা ২১ শে অগ্রাহায়ণ ফেরত দিয়ে যান। গ্রন্থাগারের জনৈক কর্মচারী একটুকরো তুলট কাগজে তা লিখে রাখেন। এই চিরকুটে পুথির নাম (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ) উল্লেখিত আছে। কাজেই বসন্ত বাবুর নামকরণ যথার্থ হয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের ধারনা, গ্রন্থটির নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরিবর্তে 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' হলেই ঠিক হতো।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থটির আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন বাংলা ভাষার মূল্যবান নিদর্শন আমাদের হস্তগত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সমকালে যা কিছু পরে বিদ্যাপতির পদাবলী, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণবিজয় লেখা হলেও এদের প্রাচীন পুঁথি পাওয়া যায়নি। যে গ্রন্থ গুলির নাম বলেছি সেগুলির ভাষা ও নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক আধুনিক হয়ে গিয়েছে। সেকারণে, বাংলা ভাষার আদিরূপ চর্যার সঙ্গে এদের তফাৎ অনেকখানি বলেই মনে হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথি এই দুইয়ের মধ্যে মিলন সেতু রচনা করেছে। পরবর্তীকালের বৈষ্ণব ভাবাদর্শের সঙ্গী শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মিল না থাকলেও লোকসমাজে এর বিশেষ প্রচলন তেমন ছিল না। মোড়কে রক্ষিত ঔষধের মত এর ভাষা অপরিবর্তিতই থেকে গিয়েছে। ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথির ভাষা আলোচনা করে বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা ১৫শ শতকের পূর্ববর্তী বলে মনে করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর মধ্যে আহ্মি, তোহ্মি, মোক,বাএ, কাহ্ন ইত্যাদি বহু প্রাচীন শব্দ আছে যেগুলি এর প্রাচীনতাকে প্রমাণিত করে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির মত প্রাচীন ভাষা মধ্যযুগীয় সাহিত্যে আর কোথাও পাওয়া যায় না।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয় বস্তু

রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা অনুসরণ করে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যখানি রচিত হয়। কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে মথুরাগমন, মথুরা হতে ক্ষণিকের জন্য প্রত্যাবর্তন মিলন রাধা কৃষ্ণের মিলন, তারপর কংস বধের জন্য কৃষ্ণের পুনরায় মথুরা গমন ও রাধার বিলাপ - এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে। তবে এই কাব্য তেরটি খন্ডে বিভক্ত হয়েছে। রাধা বিলাপের পর পুথিটি খন্ডিত হয়ে যাওয়ায় কাব্যটির শেষ পর্যন্ত বিরহে, না মিলনে শেষ হয়েছিল তা বোঝা যায় না। তবে প্রচলিত রীতি ও অলংকার শাস্ত্রের বিধান অনুসারে রাধাকৃষ্ণের মিলনের মধ্যে কাব্যটি শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই জন্য মনে হয় গ্রন্থ শেষে হয়তো রাধাকৃষ্ণের পূর্ণ মিলন বর্ণিত হয়েছিল। তবে কবি সর্বত্র যে অলংকার শাস্ত্রের নীতি মেনে চলেছেন এমন কথা বলা যায় না। মাঝে মাঝে তিনি আদি রসের এমন উৎকট প্রকাশ ঘটিয়েছেন যে তাতে রসাভাস সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আখ্যানভাগ মূলত তেরটি খন্ডে বর্ণিত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন খন্ড অনুসারে  আলোচনা করতে পারি-

(১) জন্ম খন্ড

এই জন্ম খন্ড রাধাকৃষ্ণের আর্বিভাবের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কংস নিধনের জন্য স্বয়ং বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে দৈবকীর উদরে জন্ম নিলেন এবং তাঁর সম্ভোগের জন্য বৈকুন্ঠের লক্ষী সাগরের ঘরে পদুমা উদরে রাধা রূপে জন্মগ্রহণ করলেন।

(২) তাম্বুল খণ্ড

তাম্বুল খণ্ডে এসে রাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক বেশ খসে পড়লো। রাধাকৃষ্ণের আচরণ প্রকৃত নরনারীর পর্যায়ে নেমে গেল। রাধা সব সখিগনের সঙ্গে মিলে বড়াই কে নিয়ে চলেছেন বৃন্দাবন থেকে মথুরার পথে। মাথায় দধি সরের পসরা। সখীদের সঙ্গে রস-পরিহাস করতে করতে বড়াই কে পিছনে ফেলে রাধা অনেকদূর এগিয়ে গেলেন। বড়াই তাকে খুঁজতে খুঁজতে অন্যপথে গিয়ে হাজির হল। পথমধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। বড়াই তার কাছে রাধার সন্ধান জিজ্ঞাসা করল। কৃষ্ণ তো রাধাকে চেনেনা তখন ঐ বড়াই রাধার রূপ বর্ণনা করতে লাগলো। তা শুনে কৃষ্ণের মনে রতি ভাব জেগে উঠলো। তিনি রাধা সঙ্গ লাভের জন্য আকুল হয়ে পড়লেন। একারণে রাধার সঙ্গে মিলনের জন্য কৃষ্ণ বড়াই কে অনুনয়-বিনয় করলেন। তারপর ফল তাম্বুল দিয়ে কৃষ্ণ বড়াই এর হাতে দিলেন। বড়াই কৃষ্ণের কথামতো রাধার কাছে ফল তাম্বুল নিয়ে উপস্থিত হলে, কৃষ্ণের সমস্ত কথা শুনে রাধা রুষ্ট হয়ে ফল তাম্বুল সহ লাথি মেরে ফেলে দিলেন। দেখা যায় এই খণ্ডে কৃষ্ণ তিন-তিনবার রাধার জন্য উপহার পাঠালেও বারবার রাধা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

(৩) দান খণ্ড

দান খন্ডে দেখা যায় কৃষ্ণ রাধার প্রতি ব্যভিচার করেছেন। এই খণ্ডে কৃষ্ণ তার মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য বড়াই কে সঙ্গে নিয়ে রাধাকে সম্ভোগ করলেন। কৃষ্ণের কথামত বড়াই রাধাকে ভুলিয়ে মথুরার পথে হাজির করল। সেখানেই কৃষ্ণ দানি সেজে সমস্ত দধি দুগ্ধ নষ্ট করে রাধাকে জোরপূর্বক সম্ভব করলেন।

(৪) নৌকা খন্ড

নৌকা খন্ডে দেখা যায় কৃষ্ণ পারের কান্ডারী সেজে যমুনার ঘাটে অপেক্ষা করে রইলেন এবং পার করার ছলে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে রাধার সঙ্গী জলকেলি তে মত্ত হলো। তবে এখানে রাধার প্রতিকূল বাম্যভাব দূর হলো।


(৫) ভার খন্ড

এই খণ্ডে দেখা যায় রাধা কৃষ্ণের সঙ্গী সঙ্গলাভে আকৃষ্ট। কৃষ্ণ, রাধার সমস্ত দধি দুধের পসরা মাথায় করে নিয়ে ভারী সেজে বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা করলেন।

(৬) ছত্র খণ্ড

এই খণ্ডে দেখা যায় রাধা কৃষ্ণের প্রতি একটু আসক্ত। কারণ রৌদ্রের তাপ-জ্বালা নিবারণার্থে রাধা  কৃষ্ণের মাথায় ছত্র ধরলেন। এবং রাধা তাকে রতি দানের আশ্বাস দিলেন।

(৭) বৃন্দাবন খন্ড

এই খন্ডে দেখা যায় রাধাকৃষ্ণের সম্পূর্ণ মিলন। রাধা যেমন আকুল কৃষ্ণের জন্য তেমনই কৃষ্ণ ও।

(৮) যমুনা খন্ড ও (৯) কালিয়া দমন খন্ড

যমুনা খন্ডের মধ্যে কৃষ্ণের কালিয়া দমন খণ্ডটি বিবৃত আছে। এছাড়াও এই খণ্ডে গোপীগণের সঙ্গে জলবিহার, গোপীগণের বস্ত্রহরণ বিবৃত হয়েছে।

(১০) হার খন্ড

এই খণ্ডে কৃষ্ণ রাধার হার চুরি করে নিলেন। ফলস্বরূপ রাধা যশোদা সমীপে কৃষ্ণের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন।

(১১) বাণ খণ্ড

হার খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের দুষ্কর্মের জন্য মা যশোদার কাছে নালিশ করলে কৃষ্ণ রাধার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ স্বরূপ রাধাকে মদন বাণে বিদ্ধ করলো।

(১২) বংশী খণ্ড

এই খণ্ডে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার মন বড় ই উতলা হল। বাঁশির সুরে রাধা শরীর আকুল, মন ব্যাকুল হয়ে গেল। বড়াই এর উপদেশে রাধা বংশী হরণ করে নিলেন। এরপর অনেক অনুনয় বিনয় করার পর রাধা কৃষ্ণের বাঁশি ফিরিয়ে দিলেন।

(১৩) রাধা বিরহ

রাধা বিরহ অংশে রাধার নিদারুণ বিরহ দশা উপস্থিত হল। বহু অন্বেষণের পর রাধা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন। ক্লান্তি ভরে তিনি কৃষ্ণের ক্রোড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। এই সুযোগে কৃষ্ণ ও রাধাকে ছেড়ে মথুরা গমন করলেন।

যাইহোক শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয়বস্তু একটু ভাল করে দেখলে বোঝা যায় কবি তার কাব্য মধ্যে রাধা ও কৃষ্ণ কে প্রকৃত মানব মানবীর আচার-আচরণ কেই তুলে ধরলেন। এখানে দেব মহিমা একেবারেই দ্বিখন্ডিত। বড়ু চন্ডীদাস প্রকৃত বাস্তব জীবনের নিখুঁত নর-নারীর জীবনচিত্রকে যেভাবে আঁকলেন তা মধ্যযুগের কোন কাব্যেই আমরা হয়তো পাবো না। তবে একটা কথা বলবার যোগ্য কবি যে সময়ে এই কাব্যটি রচনা করছেন সেই সময়ের সমাজবাস্তবতার, অর্থনৈতিক চেহারার, নর-নারীর আচার-আচরণ যেন  কৃষ্ণ ও রাধার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

1 comment:

  1. JAM Casino - JamBase
    JAM Casino. JamBase is a global online 양산 출장마사지 casino, also known as 안산 출장샵 JAM Casino. 서울특별 출장안마 Learn more about the JAM 춘천 출장마사지 Casino 문경 출장샵 brand and how you can join

    ReplyDelete

Popular