Saturday 31 March 2018

Reflection of Society in Sri KrishnaKirtan/শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সমাজের প্রতিফলন


শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সমাজের প্রতিফলন

সাহিত্য মূলত সামাজিক চৈতন্যের প্রকাশ। সামাজিক চিন্তাচেতনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় দেশকালের বিশিষ্ট পটে। শুধু কল্পনাবিলাস বৈভব মন্ডিত সাহিত্য হতে পারে না, তার মূল বাস্তবের মাটিতে প্রোথিত থাকে। আধুনিক কালে যে অর্থে সাহিত্যের মধ্যে আমরা সমাজ চিত্রের প্রতিফলন পাই, এমনকি মধ্যযুগে ও মঙ্গলকাব্য গুলিতে পেয়েছি, ঠিক সেই অর্থে বড়ুর রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তা মেলা ভার। অর্থাৎ বাংলাদেশে আন্তঃ সামাজিক প্রতিফলন কিভাবে বড়ুর কাব্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। কোন প্রত্যক্ষ সামাজিক চিত্র আমরা পাইনা। বলা যেতে পারে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ ও রাধার পারস্পারিক সম্পর্ক তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ ও জীবন বিস্তৃত পরিসরে প্রতিফলিত হয়েছে।

রাধার স্বামী, শাশুড়ি প্রভৃতিদের নিয়ে একটি পারিবারিক পরিবেশেই এই কাব্যের জন্ম খন্ড থেকেই তা চিত্রিত। সমাজে তখন বাল্য বিবাহ প্রচলিত ছিল। রাধা ও অতি অল্প বয়সেই আইহনের ঘরনী হলেন। 'বাঢ়ে তনুলীলা'- যৌবনে পরিণত হয়ে ও রাধার মধ্যে সতিত্বের গর্ববোধ ছিল। কৃষ্ণ যেভাবে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বলপূর্বক অধিকার বিস্তৃত করেছে তাকে তার মধ্যে দিয়েও সেদিনকার সমাজের অত্যাচারী বলযোগ্যতার ছবি একেবারে তা আড়াল থাকে না। তৎকালীন সমাজের নারীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ কাউকে নিযুক্ত করত, আমার ক্ষেত্রেও তাই হল;-"বড়ায়ি দেহ এহার পাশে", সমাজের এই অসৎ দূতিগিরি চরিত্র বড়ায়িকে আমরা দেখতে পাই।

মধ্যযুগে নারীর জীবন নানা দিক থেকেই শৃঙ্খলিত ছিল। তাদের স্বাধীন ইচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। এরই মধ্য দিয়ে আমরা এই কাব্যের বিভিন্ন জীবিকার মানুষদের দেখতে পাই। জীবিকার প্রয়োজনে গোপ পরিবারের বধুরা দই-দুধের পসরা নিয়ে হাটে যেত। ঘরের কাজের পাশাপাশি তারা বাইরের কাজ করত। নইলে তাম্বুল খণ্ডে বড়ায়ের মুখে শুনবো কেন;-"চিরকাল দধি দুধ ঘরে না হ এ।/এঁবে মথুরার হাট জাইতেঁ জু আএ"।। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পটভূমি হিসেবে যে সমাজ জীবন উপস্থিত- তার একটি হলো পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পুষ্ট ভাবধারা, আর অপরটি হল- লোকায়ত সংস্কৃতির পুষ্ট একটি সমাজ সংস্কার। বিশেষ করে বাংলার লোকায়ত জীবনই এখানে প্রায় একমাত্র প্রাধান্য পেয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে মানবসমাজে ও সংস্কৃতির আটপৌরে দিক নিয়ে সাধারণ মানুষের যে বৃত্তি নির্ভর জনজীবনের বিস্তৃত পরিচয় বা তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলি যে শুধুমাত্র সমাজ সম্বন্ধীয় নয়- পরোক্ষভাবে তা ঘটনা বিবৃত। বৃত্তি কেন্দ্রিক নানা প্রসঙ্গ পেলেও গ্রন্থ মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, নমঃশূদ্র, কুমার, তেলি, নাপিত, বৈদ্য, কান্ডারী, সাপুড়ে, জাদুকর প্রভৃতি নানা জাতি তাদের বৃত্তি নির্ভর প্রসঙ্গ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে উল্লিখিত। বাংলার সামাজিক বর্ণনা বিস্তারের এই ছবি চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ও তা সত্যতা অর্জন করেছিল। সেই একই সঙ্গে আমরা বড়ুর কাব্যে পায় তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে। শুধু তাই নয়, সাধারণ ভিখারীর প্রসঙ্গ পাই, তেমনি আমার 'খাপর' বা 'নরকপাল' হতে যোগিনীর ভিক্ষাবৃত্তির বিষয় ও বর্ণিত হয়েছে এই কাব্যে। ব্যবহারিক জীবনচর্যার দৈনন্দিন দিক অর্থাৎ আহার বিহার, বেশভূষা, চালচলন প্রভৃতি বিষয়ে ও ও কবি অভ্যাস ও সংস্কার কে ঘিরে বিভিন্ন উপাদান আহরণ করেছেন;-"আগর চন্দন আঙ্গে মাখি/ কাজলে রঞ্জিল দুঈ আঁখি।।/হেন নেহ বড়ায়ির  উদ্দেশে।/ চলি গেলি রাধিকা হরিষে।।/ ফুলে জড়ী বান্ধি কেশপাশে।/ পরিধান কর নেত  বাসে।। (রাধা বিরহ,১৭)


শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যের মধ্যে সেকালের সমাজে অলংকরণ, কেশ বিন্যাস, ইত্যাদির কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। সে যুগের মেয়েরা যে কানে কুন্ডল,হাতের কাকন চুড়ি পরত তা রাধিকার সাজসজ্জা থেকে অনুমান করা যায়।

(১) "কন্নত কুন্ডল হিরার ধার"।

(২)"বাহুতে কনক চুড়ি,মুক্তা রতনে জড়ি/রতন  কঙ্কন করমূলে"।।

শুধু এ কাব্যে রাধা বা অন্য কোন মেয়ে নয়, কৃষ্ণ কেও অনুরূপভাবে অলঙ্কারে ভূষিত করেছে। অনেক সমালোচকদের মতে সেদিনকার সমাজের যে স্বচ্ছ বা সম্ভ্রম জীবন ছিল, তারই প্রতিফলন দেখা যায়।

লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, সামাজিক প্রথা, বিধি-বিধান, আচার-রীতি ইত্যাদি বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছে এই কাব্যে। তাম্বুল খণ্ডে বড়ায়ি কর্পূর-তাম্বুল সহ কৃষ্ণের প্রেম প্রস্তাব রাধার কাছে বহন করে নিয়ে গেছে। শুভ সংবাদ, বা প্রেম প্রস্তাব পাঠানোর এটাই বোধ হয় সামাজিক প্রথা বা রীতি ছিল। নানাবিধ উৎসব অনুষ্ঠানের পশ্চাৎপটে নান্দনিক ভাবনা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কখনো ও মাঙ্গলিক কারণে কলাগাছ পুঁতি, কখনোও বা প্রথা অনুসারে পূর্ণ ঘট পেতে মঙ্গল কামনা আজকের দিনেও এক পরিচিত সামাজিক প্রথা।

আবার এই সংস্কারের পিছনেও সে সময় অন্ধ সংস্কার বা অশুভ লক্ষণ এর দৃষ্টান্ত প্রচুর আছে। শুভ-অশুভক্ষণ যাত্রা করার সংস্কার আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। হাঁচি, টিকটিকি ডাক, হোঁচট, শূন্য কলসি দরশন, ভিক্ষারত যোগিনী কে দেখা, কাকের ডাক- প্রভৃতি অন্ধ সংস্কার বিদ্যমান ছিল। এই অযাত্রা দর্শনের ফলে আজ রাধা ও কৃষ্ণের কাছে তিরস্কৃত হচ্ছে;-"আজি জখনে মোঁ বাঢ়ায়িলোঁ পা এ"।/পাঁছে ডাক দিল কালিনী মা এ"।।

এখানে রাধার উক্তিতে পিছুডাক জনিত সংস্কারের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা অশুভ বা আযাত্রা সূচক বলে আমরা আজও বিশ্বাস করি। আবার বিপরীতভাবে ও বলা যায় যে, দধি মঙ্গলের প্রতীক কিংবা বাছুরের সঙ্গী গাভীর দর্শন এইগুলি যে শুভ চিহ্ন তা এই কাব্যে আছে। অর্থাৎ মঙ্গল-অমঙ্গলের সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে যে জীবন চর্চা আমরা অনুসরণ করে চলেছি এখনো পর্যন্ত যা লুপ্ত হয়নি। তার পূর্ব প্রসঙ্গ এই প্রাচীন কাব্য গুলির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। সুতারাং এদিক দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমকালীন বাঙালি জীবনের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে অনেকটাই জায়গা জুড়ে আছে। এই ভাবেই গোটা কাব্য জুড়েই বাঙালির ভাব চেতনা ও জীবন-রসবোধ তৎকালীন সমাজ জীবনের খন্ড খন্ড উপস্থাপনায় পষ্টোজ্জল হয়ে উঠেছে।



No comments:

Post a Comment

Popular