Monday 26 March 2018

Social life in Charyapada / Literary value of charyapada

চর্যাপদে বর্ণিত সমাজ জীবনঃ-

কোন যুগের সাহিত্যই সমাজ নিরপেক্ষ নয়। চর্যাগীতির রচয়িতা সিদ্ধাচার্যগণ ব্যক্তিগত সাধনা আর সহজানন্দ উপলব্ধিকে তার নিজস্ব শিল্পের রীতিতে প্রকাশ করেছেন। সাধনা প্রত্যয়ের দিক থেকে সমস্ত চর্যাগান এর বিষয়বস্তু একই ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুস্নার কথা। কিন্তু সেই সাধন প্রনালী প্রত্যেক সাধকের আপন অনুভূতির রসে বৈচিত্র‍্য মন্ডিত হয়ে উঠেছে। তৎকালীন সাধারণ বাঙালির প্রতিদিনের ধূলিধূসরিত জীবন চিত্র, সুখ দুঃখ, হাসি কান্নার টুকরো টুকরো রেখাচিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই সমস্ত পদগুলিতে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনীন্দ্র মোহন বসুর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য;- " যেহেতু কোন কবিই পারিপার্শ্বিকতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিতে পারে না, কখনও সচেতন, কখনও অচেতনভাবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব স্বীকার করিয়া বসেন। সেই জন্য চর্যার রচয়িতাগণ ও তাদের বাস্তব পরিমণ্ডলকে মাঝে মাঝে আভাসিত না করিয়া পারেন না।"

(১) ভৌগোলিক পরিবেশ:- 

চর্যাগীতি তে যে সমস্ত উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। চর্যাপদে খাল-বিল, নদী-নালা, বিশেষত নৌকা যাত্রার অতিরিক্ত উল্লেখ থাকায় নদীমাতৃক বাংলাদেশেরই কথায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন কবি লিখেছেন;-"ভবণ ই গহণ গম্ভীর বেঁগে বাহী।/ দু আন্তে চিখিল মাঁঝে ন থাহী।।"

(২) সমাজ বিন্যাস:- 

চর্যাগীতিতে চিত্রিত সমাজচিত্রের রুপটি প্রধানত হিন্দু সমাজের। সেই সমাজের উঁচু শ্রেনীতে ব্রাহ্মণ এবং নিম্ন শ্রেণীতে ডোম, চন্ডাল, শবরদের অবস্থান ছিল। প্রকৃতপক্ষে চর্যাপদে নিম্ন শ্রেণীর জীবন কথাই বর্ণিত হয়েছে। বর্ণাশ্রম প্রথা কঠোরভাবে বিদ্যমান ছিল। নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা সভ্য সমাজ থেকে দূরে বসবাস করত। তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাহ্নপাদের একটি পদে;-" নগর বাহিরে ডোম্বী তোহোরি কুড়িআ।/ছোই ছোই জাহসো ব্রাহ্ম নাড়িআ।।" ইত্যাদি পদে।

(৩)জীবিকা:- 

চর্যাগীতিতে যে ক'টি জীবিকা বা বৃত্তির ইঙ্গিত আছে, পা খুব একটা উচ্চমানের নয়। কায়িক পরিশ্রমই ছিল তাদের প্রধান সম্পদ। যেমন, কেউ কেউ ঝুড়ি,চাঙ্গড়ি, চুপড়ি ইত্যাদি তৈরি করত। এমন কি ডোম্বীরা খেয়া পারাপারের কাজ ও করত। শুধু তাই নয়, মাদুর বোনা, কাপড় বোনা, মাছ ধরা, মদ চোলাই করার কথা ও চর্যাগানে আছে। এমন কি হরিণ শিকার ও বাণিজ্য যাত্রার কথা ও জানা যায়। হরিণ শিকারের কাহিনীতে পুশু জীবনের অব্যক্ত মর্ম যন্ত্রণার ক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছে;- " আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।/খনহ ন ছাড় অ ভুসুকু অহেরী।।"

(৪) পারিবারিক জীবন যাপন:-

চর্যা যুগে পারিবারিক জীবন ছিল একান্নবর্তী শশুর, শাশুড়ি, ননদ, পুত্রবধূকে নিয়ে বিরাট সংসার। তবে সমাজের কোন কোন স্তরে ব্যভিচার ছিল।

(৫) আমোদ-প্রমোদ:- 

সেকালের মানুষেরা খেলাধুলার মাধ্যমে অবসর সময় কাটাতো। খেলাধুলার মধ্যে দাবা খেলা ছিল জনপ্রিয়;-"করুণা পিহাড়ি খেলহুঁ নববল"। এছাড়াও নাটক ও নৃত্য গীতের প্রতি বাঙালির বিশেষ একটা ঝোঁক ছিল। মেয়েরা নৃত্যগীতে খুব নিপুণা ছিল। চর্যাপদে বন্ধু নাটক ও অভিনয়ের কথা উল্লেখ আছে;-" বন্ধু নাটক বিসমা হোই"।। নগরের ধনী ব্যক্তিরা ছিল বিলাসী। তারা পালঙ্কে শুয়ে কপ্পুর মেশানো পান খেতেন। সে সময় মদ্যপানে রেওয়াজ ছিল খুবই জোরদার।

(৬) বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়:- 

চর্যার সময়ে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। তখনকার ব্রাহ্মণ,দন্ডী, জৈন, সন্ন্যাসী প্রভৃতিদের প্রতি চর্যাকারেরা কটাক্ষ করেছেন। সিদ্ধাচার্যের মাপে ব্রাহ্মণরা বেদের কিছুই  বোঝেনা। চর্যাপদের একটি পদে আছে;-"সু অল সমাহি অ কাহি করিঅই।/সুখদুখেঁতে নিচিত মরিঅই"।।

যাই হোক যুগান্তরে পরেও চর্যাপদের মধ্যে সদ্য মুকুলিত বাংলা ভাষায় অঙ্কিত সমাজ ও সংসার চিত্র অম্লান আছে। কবিগণ আধ্যাত্ম পথের যাত্রী হয়েও বিস্মৃত হতে পারেননি জীবনের মূল স্রোত থেকে। চর্যার বিষয়বস্তু বা লক্ষ্য আধ্যাত্মিক হলেও এর জীবনবোধের উৎস সম্পূর্ণরূপেই লৌকিক জগতের বিষয়।একারণেই চর্যাপদে সেই সময়কার বাস্তব সমাজ জীবনের ছবিকে দেখতে পায়।

চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য:-

সাহিত্যের অপর নাম জীবনবেদ। চর্যাপদ গুলির অবলম্বিত বিষয়, মোটেই সাহিত্যোচিত রস বস্তু নয়। বৌদ্ধ সহজিয়ারা তাদের সাধন তত্ত্ব প্রণালী এগুলি উপজীব্য। ধর্মকেন্দ্রিক রচনা হলেও চর্যাপদ গুলি হয়ে উঠেছে সাহিত্য সম্পদে সমৃদ্ধ। ধর্মীয় দার্শনিক তত্ত্ব কে কাব্যরূপ দেওয়ার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে উচ্চাঙ্গের কবি প্রতিভার নিদর্শন। চর্যাপদের কবিদের ছন্দ, শব্দ যোজনা এবং অলঙ্কারের ব্যবহার প্রশংসনীয়। শ্লেষ, অনুপ্রাস, উপমা-রূপক ইত্যাদি অলংকারের সার্থক প্রয়োগ চর্যাপদে শিল্প সমুজ্জ্বল রূপ পেয়েছে।

(১) অলংকার:-

সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাপদ শুধুমাত্র তত্ত্বই পরিবেশন করতে চেয়েছেন। সন্ধ্যা ভাষার আড়ালে তারা শব্দের লক্ষণা শক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন। এবং পদগুলিতে আমরা উপমা, বিপরীত ভাষণ ইত্যাদি অলংকারের সন্ধান পায়। যেমন;-"নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।/বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই।।" এখানে নাচন্তি ও গান্তি শব্দের সংযুক্ত ব্যঞ্জন 'ন্ত' ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়, এটি ছেকানুপ্রাসের উদাঃ।

(২) তাল এবং ছন্দ:-

চর্যাপদ গুলি গান এবং কবিতা আকারে সজ্জিত। প্রতিটি কবিতার শিরোনামে রাগের উল্লেখ আছে। বেশিরভাগ পদই রচিত হয়েছিল প্রত্নমাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তাতে রুদ্ধদল ও দীর্ঘস্বর দ্বিমাত্রিক। যেমন;-"কা আ ত রু ব র/প ঞ্চ বি ডা ল"(৮+৮)।।

(৩) চিত্র ধর্ম, সংগীত ধর্ম এবং গীতি প্রাণতা:-

হৃদয় উৎসারিত অনুভূতির প্রকাশ করতে গিয়ে নতুন নতুন চিত্র কল্পনা, সাধন প্রনালী ও রূপ রচনা করেছেন এই বৌদ্ধ মঠের সাধকেরা। এসকল চিত্ত কল্পনায় বর্ণনীয় বস্তুতে লাবণ্য ও সৌন্দর্য ব্যক্ত করে চর্যাপদকর্তাগণ অনন্য কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও প্রত্যেকটি পদে গীতি প্রাণতা লক্ষণীয়। যেমন;-"উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।/মোরঙ্গি পীচ্ছ পরিহণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।" মনীষী হার্ডসনের মতে;- " Personal or subjective poetry or the poetry self expressions or self delineation."

(৪) ছোট ছোট গল্প বা কাহিনী প্রসঙ্গ:-

চর্যাপদের বিভিন্ন পদে আমরা ছোট ছোট গল্প ও কাহিনীর প্রসঙ্গ খুঁজে পায়। সেগুলি আজকের গল্পের মত না হলেও মূলত কাহিনীর মূলসূত্র পাওয়া যায়। যেমন;-" টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী/ হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী

(৫) সাহিত্যরস:-

চর্যাপদ হল আধ্যাত্ম সংগীত। এজন্য শান্ত রস হল এর প্রধান রস। এছাড়াও করুণরস, হাস্যরস ও অদ্ভুত রসের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন;- "দুলি দুহিপিটা ধরণ ন জাই।/রুখের তেন্তুলি কুম্ভিরে খা অ।।"

(৬) প্রবাদ প্রবচন:-

বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য চর্যাপদকর্তাগণ কোন কোন বিষয় চর্যাপদের মধ্যে চিরন্তন যুক্তি ও প্রবাদ বাক্যের মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন;-" আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।" নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্য হরিণ নিজের শত্রু।

(৭) ধাঁধা প্রসঙ্গ:-

সন্ধ্যাভাষার আড়ালের মধ্যে দিয়ে চর্যাকারেরা চর্যাপদে ধাঁধার ব্যবহার করেছেন। যেগুলি আমাদের ধাঁধিয়ে দেয়। যেমন;-"জো সো বুধি সোই নিবুধী।/জো সে চোর সোই সাধী।।"

(৮) মিষ্টিক কবিতা:-

তত্ত্ববাদী সাধকেরা ছিলেন জীবন প্রেমিক কবি। তত্ত্ব প্রধান হলেও চর্যাপদের তত্ত্ব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এই জীবন চিত্রগুলি  লোকজগতের অভিজ্ঞতা, লোক চরিত্র চিত্র দক্ষতা নয়, জীবনরস রসিকতায় ভাষ্য। চর্যাপদ জ্ঞানের বিষয় নয়- ভাবের বিষয়, তত্ত্বের মৃণালে কাব্যের শতদল।



No comments:

Post a Comment

Popular