Monday 26 March 2018

Context of Charyapada/ Writer of Charyapada প্রসঙ্গঃ চর্যাপদ

প্রসঙ্গঃ  চর্যাপদ

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন যা কিছু আবিস্কৃত হয়েছে তার সবই হল ধর্মভাবপুষ্ট পদ্য সাহিত্য। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, প্রাচীন যুগের সাহিত্য নিতান্ত ধর্মচেতনা ও গোষ্ঠীভাব সাধনাকে আশ্রয় করে সৃষ্ট হলেও উদ্দেশ্য প্রচারের প্রবণতাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ছাপিয়ে উঠেছে স্রষ্টার মধুরসিক্ত মননকল্পনা। একারনে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশনকে ও নিতান্ত প্রাচীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এইরকম বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন হল চর্যাপদ। এই চর্যাপদ কে নিয়ে দু একটা কথা আলোচনা করা হল -

রাত্রির অন্ধকার শেষ হলে দিনের আলো শুরু হয়। ভোরের প্রথম আলো যখন ফুটে ওঠে তখনও অন্ধকার জড়িয়ে থাকে। সেই আধ আলো আধ অন্ধকারে সবই কেমন অস্পষ্ট লাগে। এই ভোরের অস্পষ্টতায় পাখীরা জেগে ওঠে; তাদের কাকলী ছড়িয়ে দেয় আকাশে – বাতাসে। কিন্তু তাঁদের কলধ্বনির অর্থ সব বোঝা যায় না, কিন্তু তাঁদের আনন্দের অভিব্যাক্তি যে নতুন একটি দিনের শুরু হচ্ছে তারই আগমনী গান শোনা যায়। বাংলা সাহিত্য ও একদিন এমনি করে জন্ম নিয়েছিল। আর সেই জন্মলগ্নে পাখীর অস্পষ্ট কাকলীর মত বৌদ্ধ সাধন সঙ্গীত অপরিণত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল। ওই সময়ে দেশে তখন সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল। বর্তমান দিনে যেমন শিক্ষিত ওপরের মহলের ইংরেজি ভাষার প্রচলন আছে, সে যুগে ও অভিজাত কিংবা পদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল বেশী। সর্ব কাজেই সংস্কৃত ভাষা চলত, সাধারন মানুষ যদিও তার কিছুই বুঝতো না। সবই তাদের কাছে অন্ধকারের মতই অস্পষ্ট থেকে যেত। বাংলা ভাষার প্রথম নির্দশন ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ এই সন্ধিক্ষণে উষার আলোর মত জেগে উঠলো। চর্যাপদ আসলে বিভিন্ন পদকারদের রচিত সংকলন কোষগ্রন্থ। সদ্য জাত বাংলা ভাষাকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম সহজিয়া মঠের বৌদ্ধ সাধকগণ কয়েকটি গান রচনা করেন, যাঁরা এই ধর্মের নতুন দীক্ষা নিচ্ছেন তাঁদের কাছেই নিগূঢ় এই তত্ত্বটি প্রচার করাই ছিল এই রচনার মূল উদ্দেশ্য। এই গানগুলি চর্যাগীতি বা চর্যপদ নামে পরিচিত। এই চর্যাপদ সাধন-ভজন মূলক রচনা এতে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকগণের ধর্ম, তত্ত্বকথা, দর্শন, চিন্তা ও সাধন প্রণালী ব্যক্ত হয়েছে। চর্যাগীতিতে যোগীদের আচার ব্যবহারের নির্দেশ আছে বটে, কিন্তু সেই নির্দেশ আধ্যাত্মিক।

আবিষ্কার ও তত্ত্বপঞ্জী:-

চর্যাপদ শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, নবীন ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ হিসাবে ও বিবেচিত। ডঃ প্রয়াত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সর্বপ্রথম এই গ্রথের আবিষ্কর্তা। এশিয়াটিক সোসাইটির মেম্বার হিসাবে শাস্ত্রী মহাশয় তিনবার নেপালে যান, পুথি সংগ্রহের জন্য। শেষ একবার নেপালে যাল ১৯০৭ খ্রীঃ। তিনি নেপালের রাজদরবার থেকে তালপাতার লেখা কতকগুলি পুথির সন্ধান পান এবং সেগুলিকে “ হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নাম দিয়ে ১৯১৬ খ্রীঃ বাংলায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে প্রকাশ করেন। এতে মোট চারটি খণ্ড ছিল -  চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরোজব্রজের দোহা, কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও ডাকার্ণব। শাস্ত্রী মহাশয় সব কটাই বাংলা ভাষায় লেখা হিসাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু পরবর্তিকালে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ ভাষাতাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র প্রথম পুথি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের ভাষাই বাংলা।

চর্যাপদের কবিগণ

আমরা আগের টপিকে আলোচনা করেছিলাম বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ কে নিয়ে। এবং সেই সাথে আমরা চর্যাপদের আবিষ্কার তথ্যপঞ্জি নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছি। এবার আমরা চর্যাপদ এর বিষয়বস্তু ও কবি পরিচিতি সম্বন্ধে জেনে নেব। চর্যাপদের বিষয়বস্তু হল সহজিয়া দর্শন ও সাধন তত্ত্ব। পদকর্তাগণ সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। অশ্রদ্ধাশীল সাধারণ মানুষ যাতে সাধনার গূঢ়তত্ত্ব অবগত হতে না পারে সেজন্য সিদ্ধাচার্যগণ তাদেরগুহ্য সাধনতত্ত্বকে প্রকাশ করতে গিয়ে দুরূহ দুর্বোধ্য রূপক-সাংকেতিক, প্রহেলিকাময় ভাষার ব্যবহার করেছেন। অনূন্য ২৩ জন পদকর্তার রচিত পদ পাওয়া গিয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কবিদের ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে জেনে নেব।


(১) লুইপা:-

লুইপা একজন বাঙালি কবি। তেঙ্গুরে বাঙালি বলেই লুইয়ের নাম উল্লেখ আছে। অধ্যাপক নির্মল দাশের অভিমত;- " চর্যাগীতি সংগ্রহের প্রথম কবি লুই। শুধু পদসংখ্যার ক্রমানুসারেই, তিব্বতি ঐতিহ্যে যে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায় লুই তাঁদের মধ্যে ও অন্যতম"। মহা মনিষী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সাথে তার পরিচয় ছিল। শ্রীজ্ঞান ১০৩৮ সালে বিক্রমশীল বিহার হতে তিব্বত যাত্রা করেছিলেন। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে দশম শতকের শেষ ভাগে অথবা একাদশ শতকের প্রথম ভাগে লুইপাদের সহজ তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল। চর্যাপদে লুই প্রণীত দুটি পদ (১,২৯) সংকলিত হয়েছে।

(২) কাহ্ন পা বা কৃষ্ণাচার্য:-

'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে'কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের তেরটি পদ সংগৃহীত হয়েছে। তারমধ্যে বারটি পদ শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে এবং অপর দুটি প্রবোধ বাগচী সম্পাদিত তিব্বতীয় অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। পদরচনায় কাহ্নপাদ বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে,কাহ্নপাদ সবমিলিয়ে ৫৭ টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিব্বতীয় ৮৪ জন মহাসিদ্ধার নামের তালিকায় কানহ্ পাদ বা কনপ সপ্তদশ স্থানীয়। ৩৬ সংখ্যক চর্যাপদে কাহ্নপাদ নিজেকে জালন্ধরী পাদের শিষ্য বলে পরিচয় দিয়েছেন।

(৩) শান্তিপাদ:-

'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' এ শান্তিপাদের ভনিতায় দুটি পদ(১৫,২৬) পাওয়া যায়। কিন্তু কবির আসল নাম জানা যায়নি। এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯০ সংখ্যক পুথির বিবরণে জানা যায় শান্তিদেব রাজার ছেলে ছিলেন। সংসার ত্যাগ করে তিনি প্রথমে মঞ্জুব্রজের শিষ্যত্ব  গ্রহণ করেছিলেন। শেষ জীবনে কবি বৌদ্ধ ভিক্ষু রূপে নালন্দায় বসবাস করেন। সেখানে তিনি সর্বদা শান্তি থাকেন বলে তাকে শান্তিদেব বলেঅভিহিত করা হতো।

(৪) ভুসুকু পা:-

"আশ্চর্যচর্যাচয়" গ্রন্থের ২৩ জন কবির মধ্যে একজন অন্যতম কবি ভুসুকু। জানা যায় ধর্মপালের রাজত্বকালে কবি বর্তমান ছিলেন। তাঁর জীবিতকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ। কবির জন্মস্থান নালন্দা। ইনি ছিলেন একজন অশ্বারোহী সৈনিক। পরবর্তীকালে তিনি ভিক্ষু এবং সিদ্ধ হন। রাজপুত্র রূপে কবির প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি চর্যাপদের আটটি পদ রচনা করেছেন। তবে কবি ভুসুকু এবং শান্তিদেব যে একই ব্যক্তি এনিয়ে সংশয় আছে।

(৫) সরহ পা:-

'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' সরহপাদের চারটি পদ সংকলিত হয়েছে। কবির সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিব্বতীয় ৮৪ জন মহাসিদ্ধার তালিকায় সরহপাদের অপর নাম রাহুল ভদ্র। তবে কোন কোন পণ্ডিতের মতে, চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সরহ ভনিতার পদগুলি এক বা একাধিক সরহের রচনা বলে মনে করেন।

(৬)শবরপাদ:-

চর্যাকার শবরপাদের দুটি পদ 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' সংগৃহীত হয়েছে। কবির নামে নানা স্থানে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আবার কারো কারো মতে শবরপাদ বাংলাদেশের কোনোও পাহাড়ি জাতি বিশেষ শবর হিসাবে অভিহিত করেছেন। নাগার্জুনপাদ তাকে বজ্রযান ধর্মে দীক্ষিত করেন। কিন্তু রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের মতে শবরপাদ সরহের শিষ্য এবং লুইপাদের গুরু। শবরপাদ বজ্রযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থাবলীর  মধ্যে "বজ্রযোগিনী সাধনা", "মহামুদ্রাবজ্রগীতি" প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও চর্যাপদে আরো অন্যান্য পদকর্তা আছেন,যাঁদের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। আমরা সমস্ত পদকর্তার কথা উল্লেখ করতে পারেনি তবে বিশেষ কয়েকজন কবির কথা আমরা উপরিউক্ত ভাগে আলোচনা করেছি। সমস্ত viewers কিংবা ছাত্র ছাত্রী যদি চর্যাপদের আরো অন্যান্য কবির কথা কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় জানতে চাও তাহলে আমাকে comment করে লিখে পাঠিও। ধন্যবাদ।।

No comments:

Post a Comment

Popular