Monday 26 March 2018

Language / Historical importance of Charyapada


 চর্যাপদের ভাষা:-

বাংলা ভাষার জন্মলগ্নে সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। বৌদ্ধ সাধকেরা চর্যার ভাষার মধ্য দিয়ে সাধনার গোপনীয়তা কে অনেকটা হেঁয়ালি ভঙ্গিতে ব্যক্ত করেছেন, তাই কোন কোন পন্ডিত এই ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষাতে অভিহিত করেছেন। চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে শাস্ত্রী মহাশয়ের বক্তব্য;-" সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায় খানিক বুঝা যায় না"। এই ভাষা সন্ধ্যায় ম্লান গোধুলীলগ্নের মত এক গভীর রহস্য আছে- কতক স্পষ্ট কতক অস্পষ্ট। অর্থাৎ বাইরে এক অর্থ, ভিতর এক অন্য অর্থ; বাইরে সাধারন অর্থ, ভিতরে সুগভীর আধ্যাত্বিকতা। কোন কোন পণ্ডিতদের মতে সন্ধ্যা ভাষা না হয়ে'সন্ধা' ভাষা যার অর্থ অভিপ্রেত বা অধিপ্রায়িক রচনা। যে শব্দের অভিষ্ঠ অর্থ অনুধ্যান করে বুঝতে হয়। যাতে অদীক্ষিত বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা সহজিয়া সাধনার গূঢ় রহস্য বুঝতে না পারে এজন্য চর্যাপদকর্তাগণ সন্ধ্যা ভাষা ব্যবহার করেছেন। এই শব্দগুলি সাধন গত কতকগুলি রহস্যপূর্ণ ইঙ্গিত আছে, যা শুধু এই পথের পথিকরাই বুঝতে পারেন। সাধনার গোপনীয়তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পাড়া কতকগুলি কায়িক ও বাচনিক সংকেত সৃষ্টি করেছেন, এগুলির মাধ্যমে যোগীরা সম্প্রদায়ভুক্ত অন্য যোগীদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করতে বা তত্ত্বকথা আলোচনা করতেন। এই সংকেত এর তাৎপর্য কেবলমাত্র যোগীরাই বোধগম্য ছিল। সন্ধ্যা শব্দের কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোধগম্য হবে;- ('হরিনা' শব্দের বাহ্যিক অর্থ মৃগ/ হরিণ, কিন্তু এর সন্ধ্যা অর্থ  চিত্ত বা মন।)('করুণা' শব্দের বাহ্যিক অর্থ মৈত্রী, কিন্তু এর সন্ধ্যা অর্থ বোধিচিত্ত)।।


 চর্যাপদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব:-

সাহিত্য হল জীবনবেদ। মানব জীবনের বিচিত্র সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশার কাহিনী নিয়ে সাহিত্য গড়ে ওঠে। তাই কোন রচনার ঐতিহাসিক মূল্য আছে কিনা বিচার করতে গেলে দেখতে হবে তা জীবন কাহিনী আশ্রিত কিনা এবং ভাষা, ছন্দ ও অলংকারের সমন্বয়ে সেই রচনা চমৎকারিত্ব লাভ করে রস সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে কিনা। ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম মতবাদ ও দার্শনিকতা, সমাজ চিত্র, সাধন তত্ত্ব সাহিত্যে কাব্যমূল্যের দৃষ্টান্ত স্বরূপে চর্যাপদ ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করেছে।

প্রথমত, এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রাচীন যুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন।

দ্বিতীয়ত, চর্যাপদকে কেন্দ্র করেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্যিক ঐতিহ্যের অভিযান শুরু হয়েছে।

তৃতীয়ত, চর্যাপদের প্রত্যেকটি পদের সূচনায় রাগ রাগিনী, তাল ও লয়ের উল্লেখ আছে। এ থেকে বোঝা যায় চর্যার পদগুলি গান হিসাবে গাওয়া হতো।

চতুর্থত, চর্যাপদের রূপক প্রতীকগুলির মধ্যে তৎকালীন সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।

পঞ্চমত, সংস্কৃত চিত্রাত্মক/ চিত্রধর্মী শ্লোকের বদলে বাংলা গীতি ধর্মী পদ রচনার সূচনা।

ষষ্ঠত, চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রবেশদ্বার স্বরূপ। এই গ্রন্থের ভাষা মাগধী অপভ্রংশ স্তর অতিক্রম করে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা রূপে সদ্য উদ্ভূত প্রত্ন বাংলাভাষার প্রামাণ্য উপকরণ।

সপ্তমত, বাংলা সাহিত্যেও চর্যার সুদূরপ্রসারী প্রত্যক্ষ প্রভাব ও তাৎপর্যপূর্ণ। চর্যার অনুবৃত্তি দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর নাথ সাহিত্য ও বাউল গানে।


 চর্যাপদ সাধন বিষয়ক রচনা হলেও মানব জীবনের সুখ-দুঃখের ভিত্তিতেই এর প্রতিষ্ঠা। গভীর মর্ত্য প্রীতি ও জীবন রস রসিকতা তাদের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রূপ ও অরূপ জগত চর্যাপদে একাকার হয়ে গেছে। এই কারণগুলির জন্য চর্যাপদ ঐতিহাসিক মূল্য লাভ করে।

No comments:

Post a Comment

Popular