Monday, 26 March 2018
Context of Charyapada/ Writer of Charyapada প্রসঙ্গঃ চর্যাপদ
প্রসঙ্গঃ চর্যাপদ
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন যা কিছু আবিস্কৃত হয়েছে তার সবই হল ধর্মভাবপুষ্ট পদ্য সাহিত্য। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, প্রাচীন যুগের সাহিত্য নিতান্ত ধর্মচেতনা ও গোষ্ঠীভাব সাধনাকে আশ্রয় করে সৃষ্ট হলেও উদ্দেশ্য প্রচারের প্রবণতাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ছাপিয়ে উঠেছে স্রষ্টার মধুরসিক্ত মননকল্পনা। একারনে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশনকে ও নিতান্ত প্রাচীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এইরকম বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন হল চর্যাপদ। এই চর্যাপদ কে নিয়ে দু একটা কথা আলোচনা করা হল -
রাত্রির অন্ধকার শেষ হলে দিনের আলো শুরু হয়। ভোরের প্রথম আলো যখন ফুটে ওঠে তখনও অন্ধকার জড়িয়ে থাকে। সেই আধ আলো আধ অন্ধকারে সবই কেমন অস্পষ্ট লাগে। এই ভোরের অস্পষ্টতায় পাখীরা জেগে ওঠে; তাদের কাকলী ছড়িয়ে দেয় আকাশে – বাতাসে। কিন্তু তাঁদের কলধ্বনির অর্থ সব বোঝা যায় না, কিন্তু তাঁদের আনন্দের অভিব্যাক্তি যে নতুন একটি দিনের শুরু হচ্ছে তারই আগমনী গান শোনা যায়। বাংলা সাহিত্য ও একদিন এমনি করে জন্ম নিয়েছিল। আর সেই জন্মলগ্নে পাখীর অস্পষ্ট কাকলীর মত বৌদ্ধ সাধন সঙ্গীত অপরিণত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল। ওই সময়ে দেশে তখন সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল। বর্তমান দিনে যেমন শিক্ষিত ওপরের মহলের ইংরেজি ভাষার প্রচলন আছে, সে যুগে ও অভিজাত কিংবা পদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল বেশী। সর্ব কাজেই সংস্কৃত ভাষা চলত, সাধারন মানুষ যদিও তার কিছুই বুঝতো না। সবই তাদের কাছে অন্ধকারের মতই অস্পষ্ট থেকে যেত। বাংলা ভাষার প্রথম নির্দশন ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ এই সন্ধিক্ষণে উষার আলোর মত জেগে উঠলো। চর্যাপদ আসলে বিভিন্ন পদকারদের রচিত সংকলন কোষগ্রন্থ। সদ্য জাত বাংলা ভাষাকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম সহজিয়া মঠের বৌদ্ধ সাধকগণ কয়েকটি গান রচনা করেন, যাঁরা এই ধর্মের নতুন দীক্ষা নিচ্ছেন তাঁদের কাছেই নিগূঢ় এই তত্ত্বটি প্রচার করাই ছিল এই রচনার মূল উদ্দেশ্য। এই গানগুলি চর্যাগীতি বা চর্যপদ নামে পরিচিত। এই চর্যাপদ সাধন-ভজন মূলক রচনা এতে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকগণের ধর্ম, তত্ত্বকথা, দর্শন, চিন্তা ও সাধন প্রণালী ব্যক্ত হয়েছে। চর্যাগীতিতে যোগীদের আচার ব্যবহারের নির্দেশ আছে বটে, কিন্তু সেই নির্দেশ আধ্যাত্মিক।
আবিষ্কার ও তত্ত্বপঞ্জী:-
চর্যাপদ শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, নবীন ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ হিসাবে ও বিবেচিত। ডঃ প্রয়াত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সর্বপ্রথম এই গ্রথের আবিষ্কর্তা। এশিয়াটিক সোসাইটির মেম্বার হিসাবে শাস্ত্রী মহাশয় তিনবার নেপালে যান, পুথি সংগ্রহের জন্য। শেষ একবার নেপালে যাল ১৯০৭ খ্রীঃ। তিনি নেপালের রাজদরবার থেকে তালপাতার লেখা কতকগুলি পুথির সন্ধান পান এবং সেগুলিকে “ হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নাম দিয়ে ১৯১৬ খ্রীঃ বাংলায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে প্রকাশ করেন। এতে মোট চারটি খণ্ড ছিল - চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরোজব্রজের দোহা, কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও ডাকার্ণব। শাস্ত্রী মহাশয় সব কটাই বাংলা ভাষায় লেখা হিসাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু পরবর্তিকালে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ ভাষাতাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র প্রথম পুথি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের ভাষাই বাংলা।
প্রসঙ্গঃ চর্যাপদ
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন যা কিছু আবিস্কৃত হয়েছে তার সবই হল ধর্মভাবপুষ্ট পদ্য সাহিত্য। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, প্রাচীন যুগের সাহিত্য নিতান্ত ধর্মচেতনা ও গোষ্ঠীভাব সাধনাকে আশ্রয় করে সৃষ্ট হলেও উদ্দেশ্য প্রচারের প্রবণতাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ছাপিয়ে উঠেছে স্রষ্টার মধুরসিক্ত মননকল্পনা। একারনে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশনকে ও নিতান্ত প্রাচীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এইরকম বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন হল চর্যাপদ। এই চর্যাপদ কে নিয়ে দু একটা কথা আলোচনা করা হল -
রাত্রির অন্ধকার শেষ হলে দিনের আলো শুরু হয়। ভোরের প্রথম আলো যখন ফুটে ওঠে তখনও অন্ধকার জড়িয়ে থাকে। সেই আধ আলো আধ অন্ধকারে সবই কেমন অস্পষ্ট লাগে। এই ভোরের অস্পষ্টতায় পাখীরা জেগে ওঠে; তাদের কাকলী ছড়িয়ে দেয় আকাশে – বাতাসে। কিন্তু তাঁদের কলধ্বনির অর্থ সব বোঝা যায় না, কিন্তু তাঁদের আনন্দের অভিব্যাক্তি যে নতুন একটি দিনের শুরু হচ্ছে তারই আগমনী গান শোনা যায়। বাংলা সাহিত্য ও একদিন এমনি করে জন্ম নিয়েছিল। আর সেই জন্মলগ্নে পাখীর অস্পষ্ট কাকলীর মত বৌদ্ধ সাধন সঙ্গীত অপরিণত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল। ওই সময়ে দেশে তখন সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল। বর্তমান দিনে যেমন শিক্ষিত ওপরের মহলের ইংরেজি ভাষার প্রচলন আছে, সে যুগে ও অভিজাত কিংবা পদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল বেশী। সর্ব কাজেই সংস্কৃত ভাষা চলত, সাধারন মানুষ যদিও তার কিছুই বুঝতো না। সবই তাদের কাছে অন্ধকারের মতই অস্পষ্ট থেকে যেত। বাংলা ভাষার প্রথম নির্দশন ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ এই সন্ধিক্ষণে উষার আলোর মত জেগে উঠলো। চর্যাপদ আসলে বিভিন্ন পদকারদের রচিত সংকলন কোষগ্রন্থ। সদ্য জাত বাংলা ভাষাকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম সহজিয়া মঠের বৌদ্ধ সাধকগণ কয়েকটি গান রচনা করেন, যাঁরা এই ধর্মের নতুন দীক্ষা নিচ্ছেন তাঁদের কাছেই নিগূঢ় এই তত্ত্বটি প্রচার করাই ছিল এই রচনার মূল উদ্দেশ্য। এই গানগুলি চর্যাগীতি বা চর্যপদ নামে পরিচিত। এই চর্যাপদ সাধন-ভজন মূলক রচনা এতে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকগণের ধর্ম, তত্ত্বকথা, দর্শন, চিন্তা ও সাধন প্রণালী ব্যক্ত হয়েছে। চর্যাগীতিতে যোগীদের আচার ব্যবহারের নির্দেশ আছে বটে, কিন্তু সেই নির্দেশ আধ্যাত্মিক।
আবিষ্কার ও তত্ত্বপঞ্জী:-
চর্যাপদ শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, নবীন ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ হিসাবে ও বিবেচিত। ডঃ প্রয়াত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সর্বপ্রথম এই গ্রথের আবিষ্কর্তা। এশিয়াটিক সোসাইটির মেম্বার হিসাবে শাস্ত্রী মহাশয় তিনবার নেপালে যান, পুথি সংগ্রহের জন্য। শেষ একবার নেপালে যাল ১৯০৭ খ্রীঃ। তিনি নেপালের রাজদরবার থেকে তালপাতার লেখা কতকগুলি পুথির সন্ধান পান এবং সেগুলিকে “ হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নাম দিয়ে ১৯১৬ খ্রীঃ বাংলায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে প্রকাশ করেন। এতে মোট চারটি খণ্ড ছিল - চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরোজব্রজের দোহা, কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও ডাকার্ণব। শাস্ত্রী মহাশয় সব কটাই বাংলা ভাষায় লেখা হিসাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু পরবর্তিকালে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ ভাষাতাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র প্রথম পুথি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের ভাষাই বাংলা।
চর্যাপদের কবিগণ
আমরা আগের টপিকে আলোচনা করেছিলাম বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ কে নিয়ে। এবং সেই সাথে আমরা চর্যাপদের আবিষ্কার তথ্যপঞ্জি নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছি। এবার আমরা চর্যাপদ এর বিষয়বস্তু ও কবি পরিচিতি সম্বন্ধে জেনে নেব। চর্যাপদের বিষয়বস্তু হল সহজিয়া দর্শন ও সাধন তত্ত্ব। পদকর্তাগণ সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। অশ্রদ্ধাশীল সাধারণ মানুষ যাতে সাধনার গূঢ়তত্ত্ব অবগত হতে না পারে সেজন্য সিদ্ধাচার্যগণ তাদেরগুহ্য সাধনতত্ত্বকে প্রকাশ করতে গিয়ে দুরূহ দুর্বোধ্য রূপক-সাংকেতিক, প্রহেলিকাময় ভাষার ব্যবহার করেছেন। অনূন্য ২৩ জন পদকর্তার রচিত পদ পাওয়া গিয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কবিদের ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে জেনে নেব।
(১) লুইপা:-
লুইপা একজন বাঙালি কবি। তেঙ্গুরে বাঙালি বলেই লুইয়ের নাম উল্লেখ আছে। অধ্যাপক নির্মল দাশের অভিমত;- " চর্যাগীতি সংগ্রহের প্রথম কবি লুই। শুধু পদসংখ্যার ক্রমানুসারেই, তিব্বতি ঐতিহ্যে যে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায় লুই তাঁদের মধ্যে ও অন্যতম"। মহা মনিষী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সাথে তার পরিচয় ছিল। শ্রীজ্ঞান ১০৩৮ সালে বিক্রমশীল বিহার হতে তিব্বত যাত্রা করেছিলেন। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে দশম শতকের শেষ ভাগে অথবা একাদশ শতকের প্রথম ভাগে লুইপাদের সহজ তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল। চর্যাপদে লুই প্রণীত দুটি পদ (১,২৯) সংকলিত হয়েছে।
(২) কাহ্ন পা বা কৃষ্ণাচার্য:-
'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে'কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের তেরটি পদ সংগৃহীত হয়েছে। তারমধ্যে বারটি পদ শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে এবং অপর দুটি প্রবোধ বাগচী সম্পাদিত তিব্বতীয় অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। পদরচনায় কাহ্নপাদ বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে,কাহ্নপাদ সবমিলিয়ে ৫৭ টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিব্বতীয় ৮৪ জন মহাসিদ্ধার নামের তালিকায় কানহ্ পাদ বা কনপ সপ্তদশ স্থানীয়। ৩৬ সংখ্যক চর্যাপদে কাহ্নপাদ নিজেকে জালন্ধরী পাদের শিষ্য বলে পরিচয় দিয়েছেন।
(৩) শান্তিপাদ:-
'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' এ শান্তিপাদের ভনিতায় দুটি পদ(১৫,২৬) পাওয়া যায়। কিন্তু কবির আসল নাম জানা যায়নি। এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯০ সংখ্যক পুথির বিবরণে জানা যায় শান্তিদেব রাজার ছেলে ছিলেন। সংসার ত্যাগ করে তিনি প্রথমে মঞ্জুব্রজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। শেষ জীবনে কবি বৌদ্ধ ভিক্ষু রূপে নালন্দায় বসবাস করেন। সেখানে তিনি সর্বদা শান্তি থাকেন বলে তাকে শান্তিদেব বলেঅভিহিত করা হতো।
(৪) ভুসুকু পা:-
"আশ্চর্যচর্যাচয়" গ্রন্থের ২৩ জন কবির মধ্যে একজন অন্যতম কবি ভুসুকু। জানা যায় ধর্মপালের রাজত্বকালে কবি বর্তমান ছিলেন। তাঁর জীবিতকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ। কবির জন্মস্থান নালন্দা। ইনি ছিলেন একজন অশ্বারোহী সৈনিক। পরবর্তীকালে তিনি ভিক্ষু এবং সিদ্ধ হন। রাজপুত্র রূপে কবির প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি চর্যাপদের আটটি পদ রচনা করেছেন। তবে কবি ভুসুকু এবং শান্তিদেব যে একই ব্যক্তি এনিয়ে সংশয় আছে।
(৫) সরহ পা:-
'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' সরহপাদের চারটি পদ সংকলিত হয়েছে। কবির সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিব্বতীয় ৮৪ জন মহাসিদ্ধার তালিকায় সরহপাদের অপর নাম রাহুল ভদ্র। তবে কোন কোন পণ্ডিতের মতে, চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সরহ ভনিতার পদগুলি এক বা একাধিক সরহের রচনা বলে মনে করেন।
(৬)শবরপাদ:-
চর্যাকার শবরপাদের দুটি পদ 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' সংগৃহীত হয়েছে। কবির নামে নানা স্থানে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আবার কারো কারো মতে শবরপাদ বাংলাদেশের কোনোও পাহাড়ি জাতি বিশেষ শবর হিসাবে অভিহিত করেছেন। নাগার্জুনপাদ তাকে বজ্রযান ধর্মে দীক্ষিত করেন। কিন্তু রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের মতে শবরপাদ সরহের শিষ্য এবং লুইপাদের গুরু। শবরপাদ বজ্রযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থাবলীর মধ্যে "বজ্রযোগিনী সাধনা", "মহামুদ্রাবজ্রগীতি" প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও চর্যাপদে আরো অন্যান্য পদকর্তা আছেন,যাঁদের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। আমরা সমস্ত পদকর্তার কথা উল্লেখ করতে পারেনি তবে বিশেষ কয়েকজন কবির কথা আমরা উপরিউক্ত ভাগে আলোচনা করেছি। সমস্ত viewers কিংবা ছাত্র ছাত্রী যদি চর্যাপদের আরো অন্যান্য কবির কথা কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় জানতে চাও তাহলে আমাকে comment করে লিখে পাঠিও। ধন্যবাদ।।
History of Buddhism / Described theoretical theory of Charyapada
বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস
বৌদ্ধ ধর্ম মোটামুটিভাবে দু'ভাগে বিভক্ত- হীনযান বৌদ্ধ ধর্ম ও মহাজান বৌদ্ধ ধর্ম। বুদ্ধদেব নিজে কোন রূপ ধর্মগ্রন্থ রচনা করে যাননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উপদেশাবলী সংগ্রহ করার জন্য প্রথমত রাজগৃহ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রায় এক বছর পর বৈশালীতে দ্বিতীয় সভার অধিবেশন হয়। এরপরে মহারাজ অশোকের আমলে পাটালিপুত্রে তৃতীয় সভা এবং মহারাজ কনিষ্কের রাজত্বকালে চতুর্থ সভার অধিবেশন হয়েছিল। এইসকল ধর্মসভায় বুদ্ধদেবের উপদেশ অবলম্বন করে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম নামক তিন পিটক বা পেটিকা নামক সংগ্রহ গ্রন্থই প্রধান। এই সকল গ্রন্থই পালি ভাষায় রচিত। গ্রন্থ গুলির সন্ধান সিংহল, ব্রহ্ম, ও শ্যাম প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের দর্শনের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাকেই প্রাচীন মতেই নাম হল হীনযান। এরপর খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের দিকে মহাযান- সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান ঘটে। নাগার্জুন, অসঙ্গ, বসুবন্ধু প্রভৃতির আচার্যগণ প্রাচীন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে সংস্কৃত ভাষায় তাদের মতামত প্রচার করেছেন। এই হল মহাযান মত। তিব্বত, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে এই মত বিস্তৃতি লাভ করে।
হীনযান ও মহাযান:
হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায় মধ্যে বিরোধ চরম আদর্শ, উপদেশ, উপদেশের প্রয়োগ, সাধনার আলম্বন ও সাধন কালের পরিমাণ নিয়ে। এসকল বিষয়ে প্রাচীনেরা হীন ছিলেন বলেই তারা হীনযানী। প্রাচীন স্থবির বাদী বা থেরবাদীদের চরম আদর্শ ছিল- শূন্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে নির্বাণ অবলম্বন করে অর্হত্ত লাভ করা। কিন্তু মহাযানীদের উদ্দেশ্য ছিল আরোও উদার। তাঁরা বললেন;-" নির্বাণ লাভ করে 'অর্হৎ' হলে চলবে না; দুঃখ প্রপীড়িত বিশ্ব জীবের মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আত্ম মুক্তির ত্যাগ করতে হবে, নির্বাণ লাভের উপযুক্ত হলেও নির্বাণ ত্যাগ করে শূন্যতায় প্রতিষ্ঠিত থেকেই মহা করুণা অবলম্বনে বিশ্ব জীবের মুক্তির জন্য অনন্তকাল ধরে কুশল কর্ম করে যেতে হবে এটাই হল মহাযানীর পথ"।।
বজ্রযান ও সহজযান:
বিভিন্ন ধরনের ধর্মবিশ্বাস ও প্রচলিত সাধন পদ্ধতি ক্রম প্রবেশের ফলে মহাযান মত পরিবর্তিত ও বিশ্লিষ্ট হয় দেখা দিল দুটি মত- 'পারমিতানয়' ও 'মন্ত্রনয়'।'পারমিতানয়' পরিকল্পিত মহাযানের বিশুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্ব আশ্রয় করে। আর 'পারমিতানয়'এ অনুশীলনের উপরে গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের মন্ত্রের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে সৃষ্ট হল 'মন্ত্রনয়'। আবার এই 'মন্ত্রনয়' এর সঙ্গে নানা প্রকার দেবদেবীর পূজার্চনা, ধ্যান-ধারণা, তান্ত্রিক ক্রিয়া বিধি,গুহ্য যোগ সাধনা ইত্যাদি প্রযুক্ত হয় বজ্রযান উদ্ভূত হল। 'বজ্র' শব্দের বৌদ্ধ তান্ত্রিক অর্থ শূন্যতা, বজ্রযান তাই শূন্যতা-যান। আর অন্যদিকে বজ্রযান পন্থী একদল সাধকের কতকগুলি বিশিষ্ট মত ও সাধন পদ্ধতি অনুসরণ করে পরবর্তীকালে সহজযান নামক এক বিশেষ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এদের সাধ্য ও সহজ, সাধন ও সহজ; তাই এরা সহজিয়া সাধক রূপে খ্যাত. সহজ শব্দে অর্থ হল সহ-জাত। যে ধর্ম প্রত্যেক জীব বা বস্তুর জন্ম থেকেই উৎপন্ন তারাই বিরাজ করে। সহজিয়াগণের মূল আদর্শ এই সহজ রূপকে উপলব্ধি করে মহাসুখে মগ্ন হওয়া। এছাড়াও সহজিগণ কখনো ও সাধনার জন্য বক্রতা অবলম্বন করতেন না- সহজ সরল পথই তাঁদের সাধন জীবনের একমাত্র অবলম্বন।
চর্যাপদে বর্ণিত সাধন তত্ত্ব:
বৌদ্ধ সহজিয়াগণের সাধনা মূলত তান্ত্রিক সাধনা। তন্ত্র সাধনা হল দেহ-সাধনা- দেহকে যন্ত্র করে তার ভেতরেই পরম সত্যকে উপলব্ধি করার সাধনা। তান্ত্রিকদের মতে দেবো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র রূপ- ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যা কিছু সত্য নিহিত আছে তা এই দেহভান্ডের মধ্যে ও রয়েছে। সহজিয়াগণ বলেন, দেহের মধ্যে অবস্থান করছে যে সহজ স্বরূপ তাই হল বুদ্ধ -স্বরূপ। চর্যাপদ গুলির মধ্যে এই তন্ত্র সাধনা তথা দেহ সাধনার কথা বহুস্থলে উল্লিখিত হয়েছে। পদকর্তাগণ বারবার বলেছেন-"নিঅড়ি বোহি মা জাহুরে লাঙ্ক"। অর্থাৎ এই দেহেই আছে বোধি তাকে লাভ করার জন্য লঙ্কায় যাবার প্রয়োজন নেই। সহজিয়য়াগণ দেহের মধ্যে চারটি চক্র বা পদ্ম কল্পনা করেছেন। প্রথম চক্র অবস্থিত নাভিতে, যাকে বলা হয় 'নির্মাণ চক্র'। দ্বিতীয় চক্র হৃদয়ে, যাকে বলা হয় 'ধর্মচক্র'। তৃতীয় চক্র কন্ঠে, যাকে বলা হয় 'সম্ভোগ চক্র'। এবং চতুর্থ চক্রের অবস্থান মস্তকে, যাকে বলা হয় 'সহজচক্র বা মহাসুখচক্র'। যোগসাধনার দিক থেকে দেখা যায় এই দেহের মধ্যে তিনটি প্রধান নাড়ী আছে। একটি 'বামগা', প্রাণবাহী শ্বাসবাহী নাড়ী( হিন্দু তন্ত্র মতে -ইড়া ) বলা হয়। অপরটি 'দক্ষিণগা',প্রশ্বাসবাহী নাড়ী(হিন্দু তন্ত্র মতে- পিঙ্গলা) বলা হয়। এবং আরেকটি নাড়ী আছে তার নাম হলো 'মধ্যগা'নাড়ী, যাকে (বৌদ্ধ তন্ত্র মতে অবধূতিকা বা হিন্দু তন্ত্র মতে -সুষুম্না বলা হয়)। সাধনার ক্ষেত্রে বামগা- দক্ষিণগা এই নাড়ী দুটিকে শূন্যতা- করুণা, প্রজ্ঞা -উপায়, নিবৃত্তি-প্রবৃত্তি, গ্রাহক- গ্রাহ্য, আলি- কালী, দিবা-রাত্রি, চন্দ্র-সূর্য, ভব- নির্মাণ ইত্যাদি অনেক নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই নাড়ী দুটি দ্বৈত তত্ত্বের প্রতীক। তৃতীয় নাড়ীটি( অবধূতি বা অবধূতিকা)অদ্বয় বোধিচিত্ত বা সহজানন্দ লাভের জন্য মধ্য মার্গের প্রতিক। চার্যার বহু স্থানে নানাভাবে এই মধ্যপথে কথা বলা হয়েছে। কারণ বৌদ্ধ সহজিয়াগণের আসল সাধনা হল- সর্ব প্রকারের দ্বৈতবিবর্জিত হয়ে অদ্বয় মহাসুখে বা সহজরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকা। তন্ত্র সাধন মতে প্রথমে বামা ও দক্ষিণা নাড়ী দুটিকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে হবে।এদের "ক্রিয়াধারা স্বাভাবিক ভাবে নিম্নগা; এই নিম্নগা ধারাকে যোগের সাহায্যে প্রথমে বিশুদ্ধ করিয়া রুদ্ধ করিতে হইবে- তাহার পরে সমস্ত ধারাকে একীকরণের সাধনা; যখন সব ধারা একীকৃত হইল মধ্যমার্গে- তখন সেই মধ্যমার্গে তাহাকে করিতে হইবে উর্দ্ধগা। সেই উর্দ্ধগা ধারায় আনন্দধারা, সেই আনন্দের মধ্যে অনুভূতি তারতম্য আছে; প্রথমে যে উর্ধ স্পন্দনাত্মক আনন্দনাভূতি তাহার নাম আনন্দ,- দ্বিতীয়ানুভূতি হইল পরমানন্দ- তৃতীয়ানুভূতি বিরামানন্দ- চতুর্থানুভূতি হইল সহজানন্দ। এই চতুর্থানুভূতি সহজানন্দই হইল চতুর্থশূন্য- প্রকৃতি প্রভাস্বর সর্বশূন্য। বোধিচিত্ত উষ্ণীষ কমলস্থিত চন্দ্র,- সহজানন্দেই ঘটে সেই চন্দ্র হইতে অমৃত ক্ষরণ"।। (ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত)
Literature / Literature written before the development of language
সাহিত্য
“সাহিত্য” শব্দের মধ্যে রয়েছে “সহিত” কথাটি । “সহিত” শব্দটি থেকে সাহিত্যের উৎপত্তি। অর্থাৎ ধাতুগত অর্থ ধরলে সাহিত্য শব্দের মধ্যে একটি মিলনের ভাব দেখতে পাওয়া যায়, সে যে কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়-ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তা নয়, -“ মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানে, দূরের সহিত নিকটে, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগসাধন। সাহিত্য ব্যাতিত আর কিছু তারই সম্ভব নহে”। বস্তুত; “বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারন করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্র এবং সেই গানই সাহিত্য”।। ( সাহিত্যের তাৎপর্য ) সুতারাং , “নিজের কথা, অপরের কথা, বিশ্বজগতের কথা, সাহিত্যিকের মনোবীনায় যে সুরের ঝংকার তোলে তাঁর শিল্পসম্মত প্রকাশের নাম সাহিত্য”।।
* নিজের কথা বলতে কবি নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি ভালোলাগা ও ভালোবাসা।।
* অপরের কথা বলতে কবির নিজের কথা নয়, অপরের কথায় পরিবেশিত করেছে তার জারক রসে জারিত করে।।
* বিশ্বজগতের কথা বলতে কবি এখানে বাইরের ভূখণ্ডের আশেপাশের অবস্থার কথা বলেছে।।
* সাহিত্যর মনোবীনায় যে সুরের ঝংকার তোলে বলতে কোনো বিষয় সাহিত্যিকের অন্তরের অনুভূতি স্পর্শ পেয়ে যে রস রূপ নির্মাণ করে তোলে তারই কথা।
সাহিত্যের কাজ
‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,- “অন্তরের জিনিসকে বাহিরের ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ”।
সাহিত্যর প্রকাশ
সাহিত্য জিনিসটাই শিল্পসম্মত একটা ব্যাপার। মনের ভাবকে সাহিত্যিকরা বিচিত্র বর্ণের , বিচিত্র রূপের, বিচিত্র ছন্দে প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে এ প্রসঙ্গে আসে প্রকাশের বাহন সেটা হল অর্থ যুক্ত শব্দ। সাহিত্যের যে শব্দ গুলো হওয়া প্রয়োজন তা হল অলংকার। এবং তার অর্থ যুক্ত শব্দে থাকবে ব্যাঞ্জনা । তবেই এটাই হল সাহিত্য।
Saturday, 24 March 2018
Turkish Invasion Of Bengal & Its Consequence / বাংলায় তুর্কী আক্রমণ ও তার ফলশ্রুতি
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। এর রচনাকাল খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। চর্যাপদের পর প্রায় আড়াইশো বছর বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। আর এই বাংলা সাহিত্যের বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ হিসাবে তুর্কী আক্রমণকেই দায়ী করা হয়। এই তুর্কী আক্রমণ বাংলায় কোন আকস্মিক ঘটনা বা ভাগ্যের পরিহাস নয়- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনিবার্য পরিণাম। দ্বাদশ শতাব্দী শেষার্ধে তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজী বিহার ও বাংলাদেশ বিজয়ের জন্য অভিযান শুরু করেন এবং ত্রয়োদশ শতকের একেবারে প্রথমে বাংলাদেশের সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তুর্কীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলপূর্বক অপরকে ধর্মান্তরিত করা, অপরের সংস্কৃতিকে বিধ্বস্ত করা। তারা ছিল ধর্মোন্মাদ, যুদ্ধবাজ ও সাহসী। তারা হিন্দু দেবদেবীর মঠ, মন্দির, শিক্ষায়তন, দেবমূর্তি প্রভৃতি ধ্বংস করে মসজিদ ও মুসলিম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয় নর-নারী নির্যাতন, হত্যা, গৃহদাহ প্রভৃতির মাধ্যমে তুর্কীরা ভয়াবহ তুর্কী নাচন শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন;-" বখতিয়ারের নবদ্দীপ জয় এবং একশত বৎসর মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়িয়া মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়, ভাগ্যের পরিহাস ও নয়- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনির্বায পরিণাম"।।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। এর রচনাকাল খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। চর্যাপদের পর প্রায় আড়াইশো বছর বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। আর এই বাংলা সাহিত্যের বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ হিসাবে তুর্কী আক্রমণকেই দায়ী করা হয়। এই তুর্কী আক্রমণ বাংলায় কোন আকস্মিক ঘটনা বা ভাগ্যের পরিহাস নয়- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনিবার্য পরিণাম। দ্বাদশ শতাব্দী শেষার্ধে তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজী বিহার ও বাংলাদেশ বিজয়ের জন্য অভিযান শুরু করেন এবং ত্রয়োদশ শতকের একেবারে প্রথমে বাংলাদেশের সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তুর্কীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলপূর্বক অপরকে ধর্মান্তরিত করা, অপরের সংস্কৃতিকে বিধ্বস্ত করা। তারা ছিল ধর্মোন্মাদ, যুদ্ধবাজ ও সাহসী। তারা হিন্দু দেবদেবীর মঠ, মন্দির, শিক্ষায়তন, দেবমূর্তি প্রভৃতি ধ্বংস করে মসজিদ ও মুসলিম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয় নর-নারী নির্যাতন, হত্যা, গৃহদাহ প্রভৃতির মাধ্যমে তুর্কীরা ভয়াবহ তুর্কী নাচন শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন;-" বখতিয়ারের নবদ্দীপ জয় এবং একশত বৎসর মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়িয়া মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়, ভাগ্যের পরিহাস ও নয়- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনির্বায পরিণাম"।।
তুর্কী বিজয়ের ফলশ্রুতি: সামাজিক পরিণাম:-
তুর্কী আক্রমণের প্রচণ্ড আঘাতে বাঙালির জীবন নানাদিক থেকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে একথা ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সমাজ জীবনে এর সুফল ফলতে থাকে।
(ক) সামাজিক ভেদাভেদ:-
সেন রাজবংশের সময় দেশে কৌলিন্য প্রথা, বর্ণভেদ, জাতিভেদ, খুব কঠোর ভাবে বিদ্যমান ছিল। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য, প্রায়শ্চিত্ত ও সংস্কার সেন যুগেই ব্যাপকভাবে প্রসারতা লাভ করে। বাঙালি সমাজে শ্রেণীবিভাগ থাকায় তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দের সঙ্গে নিম্ন শ্রেণীরদের কোন হৃদয়ের সংযোগ ছিল না। ফলে নিম্নবর্গের লোকেরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ইসলামের নব্য মানবতার পরিচয় পেয়ে এই ধর্মের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।
(খ) হিন্দু সমাজের সুস্পষ্ট বিভেদ:-
শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষেরা সে যুগের কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। এদের আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বণ, সংস্কৃতির সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীর আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বণ বা সংস্কৃতির কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলনা। ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভেদ নীতি গড়ে উঠেছিল।
(গ) অখন্ড বাঙালি জাতি:-
তুর্কী বিজয়ের ফলে বিজয়ী রাজশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে অভিজাতরা সব বিভেদ, বিচ্ছেদ অবজ্ঞাকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষার কাজে এগিয়ে গেলেন। রাষ্ট্রিক ঘূর্ণিঝড়ে আলোড়িত বাঙালি জাতি আর্য অনার্য, উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একত্রে মিলিত হয়ে এক অখণ্ড বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার সুযোগ পেল। ডঃ সুকুমার সেনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন;-" আর্য- অনার্যের মধ্যে সংস্কৃতিগত ধর্মবিশ্বাসগত আচার-ব্যবহারগত ও ভাবধারাগত এইযে স্তরভেদ ইহা বিলুপ্ত হইয়া অখন্ড বাঙালি জাতি গঠিত হইয়া উঠিবার পক্ষে একটি প্রধান বস্তুর অভাব ছিল, দ্বিতীয় পক্ষের সংঘাত"।
(ঘ) হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি:-
তুর্কী আক্রমণের ফলে কেবল উচ্চ-নিম্ন বর্ণভেদ তৈরি হয়েছিল তা নয়, হিন্দু মুসলিমদের মিলন ও সাধিত হয়েছিল। দুটি স্বাতন্ত্র সভ্যতা পরস্পরের সংস্পর্শে এসে পরস্পরকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে। এবং স্বাভাবিকভাবে বাঙালি জীবনযাত্রা নানাভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, ভাষা সংস্কৃতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ-বর্জন নীতিতে নতুনত্ব প্রকাশিত হতে শুরু করল।
(ঙ) বাঙালি সমাজে অর্থনীতি প্রাধান্য:-
তুর্কী বিজয়ের পরে ভারতীয় জনজীবনের সঙ্গে যোগসূত্রে বাংলার কৃষিজ, শিল্পজাত সম্পদ বাঙলার বাইরে বিক্রিত হয়ে অর্থনীতিতে নতুন দিকের সূচনা করলো। কৃষিজীবী থেকে বহির্বাণিজ্য এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যা বাংলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম ধীরে ধীরে নগরে পরিণত হল।
(চ) হিন্দুত্ব বোধ সৃষ্টি:-
তুর্কী বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতিরূপে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম হিন্দুত্ব বোধ জাগ্রত হল। তুর্কী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায়"হিন্দু" নাম সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতির পরিচয়, উপাধি, বাংলা স্থানের নাম প্রভৃতি বিষয়ে তুর্কী বিজয়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তুর্কী বিজয়ের ফলশ্রুতি: সাহিত্যের প্রভাব:-
(ক) মঙ্গলকাব্যের শাখা:-
তুর্কী বিজয়ের বহুমুখী প্রভাবের অন্যতম হলো সাহিত্যের নতুন চেতনার প্রকাশ। তুর্কী শাসনকালে অর্থাৎ অন্ধকার যুগে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ বিপদ থেকে ত্রাণের জন্য মনষা-চণ্ডী ইত্যাদি দেবদেবীর কল্পনা করেছেন। পরবর্তীকালে এই সমস্ত লোকায়তিক দেবতা ক্রমশ উন্নততর হয়ে মঙ্গলকাব্যের দেবতারূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো। রাষ্ট্রীয় অভিঘাতের আকস্মিক দিক প্রকাশ অনন্যপায় উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের অনেক অনার্য দেবদেবীকে স্বীকার করে নিল। উচ্চ-নিম্ন বর্ণের এই সহজ যোগাযোগের ফলে মঙ্গলকাব্য নামক কাব্য ধারাটি শিল্পসম্মত রুপ পেয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক আশ্চর্য সংযোজন রূপে প্রকাশ হলো।
(খ) অনুবাদ সাহিত্য শাখা:-
এই নবগঠিত বাঙালি জাতির সামনে সর্বভারতীয় পৌরাণিক হিন্দুত্বের একটি আদর্শকে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভূতি হয়েছিল; রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের কাহিনী অনুবাদের বাসনা এমনইভাবে জন্ম নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ডঃ দীনেশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন;-" মুসলমান, ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন"। অন্ধকার পর্বের অর্থাৎ ( ১২০১-১৪০০ ) প্রায় দুশো বছরে যেমন মঙ্গল দেব দেবীর পূজার্চ্চনার বিস্তার ঘটিয়েছে, তেমনি অপৌরাণিক জনসংস্কৃতির মর্জ্জায় রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে পুরাণ কাহিনীর রস প্রবেশ করেছে। পৌরাণিক হিন্দুধর্মের আদর্শ সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে এই তথ্যগুলি অনুবাদের প্রয়োজন দেখা দিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সূচনায় ছিল ধর্মীয় সংস্কৃতিক ও প্রতিরোধের সাহিত্য। বলা যেতে পারে নব্য গঠিত বাঙালি জাতি বিশিষ্ট রূপে আত্মপ্রকাশের সাহিত্য।
সুতরাং এইভাবেই তুর্কী আক্রমণের ফলেই বাংলা সমাজে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মিলন হয়েছিল তেমনি হিন্দু-মুসলিম জাতির সমন্বয় ও ও সাধিত হয়েছে একান্ত সহজভাবে। শুধু তাই নয়, এরই ফল স্বরূপে সাংস্কৃতিক জীবনের বিস্তৃত বিকাশ ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে। নতুন ভাবে জেগেছে সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা। তাই ঐতিহাসিক দিক থেকে তুর্কী আক্রমণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
Labels
Tags
Popular
-
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণচরিত্রের অভিনবত্ব: দীর্ঘকাল ধরে পদাবলী সাহিত্য পাঠের সূত্রে কৃষ্ণচরিত্রের যে মহিমান্বিত, প্রেমিক অথচ সম্ভ...
-
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা এবং পদাবলী সাহিত্যের রাধা কি এক? রাধা চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা কর। পদাবলী সাহিত্যে যে রাধা চরিত্রের সঙ্গে আমরা প...
-
বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা ভাষায় রচিত পদাবলী সাহিত্যের আদি কবি রূপে সিকৃতি লাভ করে বড়ু চন্ডীদাস। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক একখানি বৃ...
blogger-disqus-facebook